গ্লুকোমা হল চোখের এমন একটা রোগ, যা 12 মিলিয়ন ভারতীয়কে আক্রান্ত করেছে, এবং তাঁদের মধ্যে এক কোটি মানুষ স্থায়ী অন্ধত্বের শিকার। বিশ্বজুড়ে প্রায় 78 মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত । সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) সংজ্ঞা অনুযায়ী, গ্লুকোমা হল এমন রোগ, যাতে অপটিক নার্ভের ক্ষতি হয় এবং দৃষ্টিশক্তিক্ষীণতা আর অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দেয় । গ্লুকোমা তখনই হয়, যখন চোখের মধ্যে তরলের চাপ স্বাভাবিকের থেকে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। যদিও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক চাপেও গ্লুকোমা হতে পারে। তাই আমরা যখন ‘পৃথিবী উজ্জ্বল, আপনার দৃষ্টিশক্তিকে সামলে রাখুন’ – এই স্লোগান নিয়ে 7 থেকে 13 মার্চ বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ পালন করছি, তখন আপনার জেনে রাখা দরকার যে এই রোগ, তার উপসর্গ ও চিকিৎসার সম্ভাব্য পদ্ধতিগুলো কী কী ।
গ্লুকোমা কী
হায়দরাবাদের ভিআইএনএন হাসপাতালের চিকিৎসক, এমডি (জেনারেল মেডিসিন) রাজেশ ভুক্কালা বলেন, যে গ্লুকোমার অর্থ চোখের ভিতরে চাপ তৈরি হওয়া। এর নানা কারণ থাকতে পারে, তাদের অন্যতম হল চোখের মধ্যে থাকা রক্তবাহে ব্লকেজ। চোখের মধ্যে সবসময়ই তরল পদার্থ পৌঁছাচ্ছে এবং যদি তারা বাধা পায়, তাহলে চাপ তৈরি করে। এর জেরে চোখের স্নায়ুতে চাপ পড়ে এবং দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে ।
এছাড়াও আমরা কথা বলেছিলাম আয়ুর্বেদের ইতিহাসে পিএইচডি, ড. পি ভি রঙ্গনায়কুলুর সঙ্গে। তিনি বলেন, “ক্ষত, দুর্ঘটনা, ট্রমা, সংক্রমণ, জিনগতভাবে, চোখে অস্ত্রোপচারের জেরে গ্লুকোমা তৈরি হতে পারে। যখন আমাদের চোখ তার স্বাভাবিক অভ্যন্তরীণ চাপ বজায় রাখতে পারে না, যাকে ইন্ট্রাঅকিউলার প্রেসার (আইওপি) বলে, তখন অপটিক নার্ভে চাপ পড়ে যা একটা সময় পরে গ্লুকোমায় পরিণত হয়।”
এর জেরে নেমে আসা অন্ধত্ব থেকে মুক্তির পথ নেই। আমাদের আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ আরও জানান, যে আয়ুর্বেদে এই রোগের দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে এবং একে ‘অধিমন্থ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। চিহ্ন ও উপসর্গের ভিত্তিতে একে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, যদি ঠিক সময় নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা অত্যন্ত কার্যকর হয় ।
গ্লুকোমার চিহ্ন ও উপসর্গ
ড. রঙ্গনায়কুলুর কথা, কোনও ব্যক্তির গ্লুকোমা হলে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা যেতে পারে:
- চোখ টেনে ধরার মতো অনুভূতি
- চোখে ব্যাথা ও মাথার যন্ত্রণা
- ঘোলাটে চোখ
- চোখ চুলকোনো এবং তরল নিঃসরণ
- আলোর চারপাশে হেলো দেখতে পাওয়া
- দৃষ্টিশক্তি হ্রাস
- চোখ তামাটে হওয়া
- চোখে চটচটে অনুভূতি
ড. ভুক্কালা বলেন যে প্রাথমিকভাবে কোনও উপসর্গই ধরা পড়ে না, যদি না চোখের চেক আপ করানো হয় এবং চোখের চাপ মাপা হয়। চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়তে দেরি হয়, তাহলে নার্ভের ক্ষতির জেরে স্থায়ী অন্ধত্ব নেমে আসতে পারে ।
চিকিৎসা
গ্লুকোমার চিকিৎসায় সাবধান থাকা উচিত, কারণ অস্ত্রোপচারে পরিস্থিতি খারাপও হতে পারে। আমাদের বিশেষজ্ঞ জানালেন যে আয়ুর্বেদে গ্লুকোমার চিকিৎসা হিসেবে ভেনিসেকশন (শিরাভেদ) পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। এই পদ্ধতির আগে চোখে ওষধিযুক্ত ঘি, ওষধিযুক্ত ধোঁয়া এবং ড্রপ প্রয়োগ করবেন বিশেষজ্ঞ । গ্লুকোমার চিকিৎসায় কয়েকটি পরামর্শ দেওয়া হল:
- পুনর্নবা এবং গোক্ষুরার মিশ্রণ 30 মিলিলিটার করে দিনে দু'বার, একমাস ধরে খেতে হবে।
- গোক্ষুরাদি গুগ্গুলের দুটি করে ট্যাবলেট দিনে দু'বার করে একমাস খেতে হবে।
- দুফোঁটা করে পুনর্নবা ড্রপ দিনে তিনবার করে একমাস চলবে।
- মাথায় বলধাত্রীয়াদি তেল মাখতে হবে।
- দুধের সঙ্গে বিটনুন, ষষ্টিমধু, বড় মরিচ এবং ভেটিভার মিশিয়ে চোখের ড্রপ তৈরি করতে হবে।
- ত্রিফলাঘৃত 10 গ্রাম করে দিনে দুবার খেতে হবে।
(চিকিৎসা চলবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে)
ড. রঙ্গনায়কুলু বলেন, “এটা নিজে থেকে চিকিৎসা করার মতো রোগ নয়। অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। ড্রপ বা ওষধি ঘৃতের প্রলেপের মতো আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শুরু করার আগে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন।” তিনি আরও বলেন, যে চোখকে বিশ্রাম দিয়ে, উজ্জ্বল বস্তুর দিকে না তাকিয়ে, ভালভাবে ঘুমিয়ে এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে গ্লুকোমা থেকে সেরে ওঠা যেতে পারে।
আরও পড়ুন : ওয়ার্ক ফ্রম হোমের জেরে বাড়ছে চোখ, কানের সমস্যা
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ড. ভুক্কালা বলেন, যে গ্লুকোমা শুরুতেই ধরা পড়লে, শুধুমাত্র চোখের ড্রপ দিয়েই তা সারানো যেতে পারে। যদি রোগ বেড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তরল বের করে দেওয়া হয় । তাই প্রত্যেককেই নিয়মিত, বছরে অন্তত একবার চক্ষুপরীক্ষা করাতে হবে, যাতে স্থায়ী ক্ষতি এড়ানো যায় ।