জগদ্দল, 6 জানুয়ারি: একদিকে তৃণমূলে প্রবীণ-নবীন দ্বন্দ্ব! অন্যদিকে ব্যারাকপুরে শিল্পাঞ্চলে সাংসদ-বিধায়কের কাজিয়া! এই দুই যেন এখন চর্চার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে বঙ্গ রাজনীতিতে। দ্বন্দ্বের মাঝেই যতদিন যাচ্ছে ততই যেন যুযুধান দুই তৃণমূল নেতা অর্জুন সিং ও সোমনাথ শ্যামের বাকযুদ্ধে বেড়ে চলেছে। এ যেন কেউ কাউকে ছাড়ার পাত্র নয়! মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বার্তার পরও। কার্যত সাংসদ-বিধায়কের বাকযুদ্ধে যেন ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল কুরুক্ষেত্র হয়ে রয়েছে। কিন্তু, প্রশ্ন হল কী কারণে এই দুই তৃণমূল নেতার মধ্যে এত দ্বন্দ্ব ? কেনই বা সাংসদের প্রতি এত ক্ষোভ জগদ্দলের বিধায়কের ? তৃণমূল বিধায়ক সোমনাথ শ্যাম সেই সমস্ত প্রশ্নেরই সোজাসাপ্টা জবাব দিলেন ইটিভি ভারতের মুখোমুখি হয়ে।
প্রশ্ন: আপনি সাংসদ অর্জুন সিংয়ের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনেছেন । দেগঙ্গার চাকলার সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী দলের দ্বন্দ্ব মেটাতে কড়া বার্তা দিয়েছেন। তবুও আপনাদের এই দ্বন্দ্ব কেন থামছে না ?
উত্তর: কোনও ব্যক্তিগত বিরোধিতার কথা আমি বলিনি । ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে রাজনীতি করা আমার উদ্দেশ্য না । তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের বিরুদ্ধে যে অন্যায় করা হচ্ছে তার প্রতিবাদে আমি বলেছি । অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
অর্জুন সিং তৃণমূলে যোগদান করেছেন 2022 সালে। তারপর থেকে উনি আমার বিধানসভা এলাকায় সভা করে আমার বিরুদ্ধে কিছু না কিছু বলেছেন । তারপরও আমি কিছু বলিনি । ভিকি যাদব খুনের ঘটনার পর যখন দেখা গেল ওনার ভাইপো পাপ্পু জড়িত, তখনই আমি প্রকাশ্যে বলেছি । এখন সে কারও ভাই হতে পারে, ভাইপো হতে পারে, বন্ধু হতে পারে । এর জন্য আমি কিছু বলব না এটা তো কোথাও লেখা নেই । ঘটনাচক্রে পাপ্পু সাংসদের ভাইপো, তাতে তো আমার কিছু করার নেই ।
প্রশ্ন: দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে আপনার এবং সাংসদের সঙ্গে বসে এই দ্বন্দ্ব মেটাতে মীমাংসা সূত্র বের করার চেষ্টা হয়েছিল । সাংসদকে নিয়ে সুব্রত বক্সী নৈহাটি এসেছিলেন বৈঠকের জন্য । কিন্তু আপনি সেই বৈঠকে উপস্থিত হননি । তারপরও আপনার এবং সাংসদের বাকযুদ্ধ কিন্তু থামেনি । আপনি কি এর মীমাংসা করে সন্ধি করতে চাইবেন ?
উত্তর: মিডিয়া এটা প্রচার করেছে আমাদের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী এসেছিলেন বৈঠক করতে। আসলে সাংসদ এবং সুব্রত বক্সী এসেছিলেন নৈহাটি উৎসবের আমন্ত্রণ পেয়ে । মিডিয়া সেটাকে ভুল প্রচার করেছে । নৈহাটি উৎসবে আমিও একাধিকবার গিয়েছি । কিন্তু সেদিন হয়তো কোনও ব্যস্ততার কারণে আমি যেতে পারিনি । তা না হলে আমিও সেখানে যেতাম ।
প্রশ্ন: যাকে নিয়ে আপনার এত ক্ষোভ ! সেই সাংসদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগও এনেছেন ইতিমধ্যে । দলের তরফে যদি এর মীমাংসা করা হয় আপনি কি সাংসদের সঙ্গে কোনও রকম সন্ধি করবেন ?
উত্তর: আগামী দিন কি হবে জানি না। আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । আমাদের দলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ওনাদের উপদেশ মেনেই আমরা সবকিছু করি। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছি। আমাদের দলের কর্মী খুন হয়েছে। এর পিছনে যে বা যারা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াই। কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়াই নেই আমার। আগামী দিন এই খুনের পিছনে আরও অনেকের নাম জড়াতে পারে।
প্রশ্ন: মুকুল রায় তৃণমূলের যোগদানের পর থেকে তৃণমূল ছেড়ে যারা অন্য দলে গিয়েছিলেন তাদের অনেকে আবার ফিরে এসেছেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেও অনেকে তৃণমূলে যোগদান করেছেন। তখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে দলে যোগদান করানো হবে। আপনি কি মনে করেন 2022 সালে অর্জুন সিং তৃণমূলে যোগদান করার পরে তার প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার ছিল ?
উত্তর: আমাদের দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কুণাল ঘোষ এবিষয়ে মন্তব্য করেছেন। তার মন্তব্যে আমি একমত। এরপর আমার আর মন্তব্য করা উচিত নয়!যেখানে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিষয়টি দেখছেন, মন্তব্য করছেন। সেখানে আমি আর নতুন করে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নই।
প্রশ্ন: ভিকি যাদব খুনের ঘটনায় পাপ্পু সিং গ্রেফতারের পর সাংসদ ব্যারাকপুর আদালতে উপস্থিত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন যারা দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে তাদের সিকিউরিটি তুলে নেওয়া হোক। তাহলে তারা ঘর থেকে বেরোতে পারবে না। দলের কাছে এই আর্জি জানিয়েছেন তিনি। নাম না করলেও আপনাকে ইঙ্গিত করেই একথা বলেছিল সাংসদ। এবিষয়ে আপনি কী বলবেন ?
উত্তর: এর উত্তর আমাদের দলের উচ্চ নেতৃত্ব কুণাল ঘোষ দিয়ে দিয়েছেন। এটা দলের সিদ্ধান্ত। কাকে সিকিউরিটি দেওয়া হবে, আর দেওয়া হবে না।এটা পুরোপুরি দলীয় সিদ্ধান্ত।
প্রশ্ন: অর্জুন সিংয়ের ভাইপো গ্রেফতারের পর সাংসদ আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এই ঘটনার পর পাপ্পুর জনপ্রিয়তা অনেক বাড়বে। সাংসদের পরিবার থেকে নতুন কোনও নেতা উঠে আসবে। আপনিও কী তাই মনে করেন ?
উত্তর: আদালতে দাঁড়িয়ে দোষীরাও অনেক সময় বলে তারা বেকসুর। তবে কে কি বলল এবিষয়ে মন্তব্য করব না, কারণ বিষয়টি বিচারাধীন। এর উত্তর আগামীদিন পাওয়া যাবে। তবে নেতা তৈরির ব্যাপারে উনি বলতে পারবেন। জেলের সব কয়েদিদের নেতা করবেন, না অন্য কাউকে করবেন সেটা উনিই জানেন। আমি ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছু বলব না।
প্রশ্ন: সামনেই লোকসভা নির্বাচন। দলের তরফ থেকে ব্যারাকপুরে যদি অর্জুন সিংকে টিকিট দেওয়া হয় তাহলে কী আপনি রাস্তায় নেমে ওনার হয়ে প্রচার করবেন ?
উত্তর: আমার মাথার উপরে দল রয়েছে। রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা আছে বলেই আজ আমি বিধায়ক। তাই দল যেটা বলবে সেটা মাথা পেতে নেব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে বলেছেন, তাই লড়ছি। তবে, টিকিটের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। কারণ, টিকিট কে পাবেন, পাবেন না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে দলই। তাই, এই আলোচনা করার মত ক্ষমতা আমার নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের আমি একনিষ্ঠ কর্মী। দলের জন্য আমি সব সময় থাকব।
প্রশ্ন: দলের তরফে কুণাল ঘোষ আপনার পাশে দাঁড়ালেন। কিন্তু রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী পাশে থাকলেন না! কী বলবেন ?
উত্তর: আপনি ভুল ব্যাখ্যা করছেন। আমাদের দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন, আমার সঙ্গে ওনার খুব ভালো সম্পর্ক।ব্যাখ্যাটা ভুল। আমি বৈঠকে যাইনি এটা মিডিয়া প্রচার করেছে। তার মানে এটা নয় যে ওনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই, সম্পর্ক নেই। এটা ভুল ব্যাখ্যা। আমি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীকে জেতা বিধায়ক। উনি আমাদের নেতা দলের রাজ্য সভাপতি। তাই এই প্রশ্নটা ঠিক নয়।
প্রশ্ন: যেটা চলছে তাতে আগামী দিনে যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে কি আপনি দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেবেন ?
উত্তর: আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই। আমি বারংবার বলেছি আমার অস্তিত্ব দলকে ঘিরেই। আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাইরে কিছু বুঝি না।
আরও পড়ুন: