হাড়োয়া, 22 জুলাই : হাড়োয়ায় বোমাবাজি ও গুলিকাণ্ডে কি শুধুই তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের লড়াই ? নাকি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে পুলিশের সামনে । ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ আধিকারিকদের কাছে ভেড়ির দখলদারির তত্ত্ব জোরালো হচ্ছে ক্রমশ । নিহত যুবক সন্ন্যাসী সর্দারের ভাইয়ের কথাতেও উঠে এসেছে সেই তত্ত্ব । তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিকের বিরুদ্ধে তাঁর দাদাকে খুনের অভিযোগ করেছেন বাহাদুর সর্দার ৷
তাঁর অভিযোগ, ভেড়ির লাখ লাখ টাকা ফান্ডে জমা হলেও সেই টাকায় কোনওরকম উন্নয়ন না করে, মাতব্বরি করত যজ্ঞেশ্বর । প্রতিবাদ করা হলেও কোনও সুরাহা হত না । উল্টে ওই তৃণমূল নেতা তার দলবল নিয়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার করত বলে অভিযোগ তৃণমূল কর্মী বাহাদুর সর্দারের । ঘটনায় ইতিমধ্যে 21 জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৷ তবে, মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিক এখনও পুলিশের নাগালের বাইরে । পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার পর থেকেই সে অন্যত্র গা ঢাকা দিয়েছে।
উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া মূলত নদী ও ভেড়ি বেষ্টিত এলাকা । সেখান থেকেই বয়ে গিয়েছে বিদ্যাধরী নদী । রয়েছে একাধিক জলাশয় । এই সমস্ত জলাশয় ঘিরেই গড়ে উঠেছে বিঘার পর বিঘা মাছের ভেড়ি । যেখান থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন হয় । স্থানীয় সূত্রে খবর, এই ভেড়িগুলির দখলদারি নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল তৃণমূলের বিবাদমান দুই গোষ্ঠী তপন রায় এবং যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিকের মধ্যে । যজ্ঞেশ্বর তৃণমূলের মোহনপুর অঞ্চলের সভাপতি । অন্যদিকে, তপন রায় তৃণমূলের স্থানীয় নেতা । তিনি আবার তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি খালেক মোল্লার ঘনিষ্ঠ । যে কোনও বিষয়ে দুই তৃণমূল নেতার মধ্যে কাজিয়া লেগেই থাকত বলে অভিযোগ । যা নিয়ে বারবার অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে শাসকদলকে ।
জানা গিয়েছে, ভেড়ির উপার্জনের টাকা দিয়ে মোহনপুর গ্রামের উন্নয়নে খরচের জন্য একটি ফান্ড তৈরি করা হয়েছিল তৃণমূলের তরফে । অঞ্চল সভাপতি হওয়ায় যজ্ঞেশ্বর ভেড়ির টাকার কর্তৃত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছিল বলে অভিযোগ । কিন্তু তা হতে দিচ্ছিলেন না বিরুদ্ধ গোষ্ঠী তপন রায়ের অনুগামীরা । তাঁরা চাইছিলেন, ফান্ডে জমা পড়া ভেড়ির টাকা খরচ করা হোক গ্রামের উন্নতিতে । একই দাবি ছিল গ্রামবাসীদেরও ।
এই নিয়ে সম্প্রতি দুই তৃণমূল নেতার বিরোধ চরমে উঠেছিল । সংঘর্ষেও জড়িয়ে ছিলেন বিবাদমান দুই গোষ্ঠীর অনুগামীরা । ফলে এনিয়ে আগে থেকেই উত্তপ্ত ছিল মোহনপুর অঞ্চল । বুধবার তৃণমূলের শহিদ দিবসে দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভার্চুয়াল বক্তব্য শুনে ফেরার পথে টেংরামারি এলাকায় ফের সংঘর্ষে জড়ান তপন রায় এবং যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিকের অনুগামীরা । সংঘর্ষে একে অপরকে লক্ষ্য করে বোমা এবং গুলি চালায় বলে অভিযোগও উঠেছে । তাতেই নিহত হয়েছেন লক্ষ্মীবালা মণ্ডল (60) এবং সন্ন্যাসী সর্দার (32) নামে দু’জন । আহত হয়েছেন কমপক্ষে 12 জন । এদের মধ্যে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরজিকর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন । সংঘর্ষে আহত বাকিদের চিকিৎসা চলছে হাড়োয়া গ্রামীণ হাসপাতালে । ঘটনার পর থেকেই থমথমে গোটা গ্রাম । পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে টেংরামারি এলাকায় বসানো হয়েছে পুলিশ পিকেট । চলছে কমব্যাট ফোর্সের টহলদারিও ।
এদিকে বোমা ও গুলি চালানোর ঘটনায় দু’জনের মৃত্যুতে তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিক এবং তার অনুগামী টেংরামারি বুথের সভাপতি ভাস্কর দাসকে দায়ী করেছেন নিহতের পরিবারের লোকজন । তাঁদের অভিযোগ, পরিকল্পনা করেই গতকালের ঘটনা ঘটানো হয়েছে । বুথ সভাপতি ভাস্কর দাসের বাড়ি সংলগ্ন চালাঘর থেকেই এলোপাতাড়ি গুলি চলেছে ৷ দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছে নিহতদের পরিবার ৷
ঘটনার পর নিহতের পরিবারের তরফে মোট 31 জনের বিরুদ্ধে হাড়োয়া থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে । সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ এখনও অবধি তৃণমূলের বুথ সভাপতি ভাস্কর দাস-সহ মোট 21 জনকে গ্রেফতার করেছে । মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিক সহ বাকি অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে বলে জানিয়েছে হাড়োয়া থানার পুলিশ ।