সন্দেশখালি, 10 জুন : জিনসের প্যান্ট, হাফ হাতা শার্ট । বেশ যত্ন করে ব্যাক ব্রাশ করা চুল । আপাত শান্ত এই মানুষটার অঙ্গুলিহেলনেই চলে গোটা এলাকা । প্রশাসন থেকে দল সমস্ত সিদ্ধান্তের নেপথ্যে সেই । খুন, নারী পাচার, সোনা পাচার-সহ একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত । স্থানীয়রা বলে, সন্দেশখালির ঘটনার পিছনে রয়েছে শেখ শাহজাহানই !
সেদিনও বিকেল নেমেছিল আর পাঁচটা দিনের মতোই । সামান্য আগেও কেউ ভেবে উঠতে পারেননি নেপথ্যে কী ভীষণ ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে । আচমকাই ফায়ারিং-র শব্দ । একই সঙ্গে শোনা গেছিল বুক ফাটা চিৎকার । ততক্ষণে চোখ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে তপ্ত সিসার বুলেটটা । একটা নয়, বারবার গর্জে উঠেছে বন্দুক । শুধু গুলি ছুড়েই ক্ষান্ত থাকেনি দুষ্কৃতীরা । সংঘর্ষ শেষ হয়েছিল ধারালো অস্ত্রের কোপে, চাপচাপ রক্তের ছোপে ।
এই সংক্রান্ত খবর : একরাতেই সন্দেশখালিতে শ্মশানের নিস্তব্ধতা !
তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছিল । বাকি অনেকেই নিখোঁজ । আত্মীয়, প্রতিবেশীরা কেউ জানেনই না তাঁরা কোথায় । সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় প্রদীপ মণ্ডলের । আজ তাঁর স্ত্রী পদ্মা মণ্ডল ও নিখোঁজ দেবদাস মণ্ডলের স্ত্রী সুপ্রিয়া মণ্ডল সন্দেশখালি থানায় FIR করেন । FIR-এ শেখ শাহজাহান সহ 25 জনের নাম রয়েছে ।
এই সংক্রান্ত খবর : কারা যেন বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে, সন্দেশখালির হাওয়ায় ভাসছে আতঙ্ক
ট্রেকারের সামান্য কন্ডাক্টর থেকে ব্লক তৃণমূল সভাপতি । কেমন ছিল শাহাজনের রাজনীতির জগতে প্রবেশের গল্পটা ?
এই সংক্রান্ত খবর : দেহ আনা গেল না কলকাতায়, সন্দেশখালিতেই সৎকার
সন্দেশখালির সরবেড়িয়ার শেখ শাহজাহান । শিক্ষাগত যোগ্যতা ক্লাস সেভেন । খুব অল্প বয়সেই রোজগারের রাস্তায় নেমেছিল সে । জীবন শুরু হয় ট্রেকারের কন্ডাক্টরের কাজ দিয়ে । পরে ট্রেকারের চালকও হয় সে । কিন্তু, মন মানেনি । চাই আরও কিছু । 2000 সাল, তখন রাজ্য দাপাচ্ছে বামেরা । সরবেড়িয়া-আগারহাটি পঞ্চায়েতের CPI(M) প্রধান মোসালেম শেখের সংস্পর্শে আসে শাহজাহান । প্রথমে প্রধানের ঘরে চা-জল দেওয়ার কাজ করত । ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ । বাম নেতাদের হাত ধরে সন্দেশখালিতে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে । হাত বাড়ায় অপরাধ জগতে । সোনা পাচার, নারী পাচার, খুন, রাহাজানি-সহ একাধিক অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে । স্থানীয়রা বলেন, মাথায় বাম নেতাদের হাত থাকায়, আইন তাকে ছুঁতে পারেনি ।
2009 সাল । সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের তপ্ত বাতাস ছেয়ে গেছে গোটা রাজ্যে । পালাবদলের হাওয়া বইতে শুরু করেছে । সাম্রাজ্য রাখতে ঠিক এমন সময় বাম সঙ্গ ত্যাগ করে শাহজাহান । যোগ দেয় তৃণমূল কংগ্রেসে । 2009 সালে লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাট থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হন হাজি নুরুল । দেরি করেনি শাহজাহান । দলবল নিয়ে তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে প্রচারে নেমে পড়ে । খুব তাড়াতাড়ি দলের নজরেও পড়ে যায় ।
এই সংক্রান্ত খবর : পাঁচমাস আগেই বিয়ে হয়েছিল, এক বুলেটেই স্বপ্ন শেষ
পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা, পৌরসভা থেকে লোকসভা । দলের হয়ে ভোট করানোর দায়িত্বে থাকত সেই শাহজাহানের উপরই । পুরস্কারও মিলে যায় হাতেনাতে । সন্দেশখালির ব্লক তৃণমূল সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় । সেই সঙ্গে মেলে সরবেড়িয়া-আগারহাটি পঞ্চায়েতের প্রধানের দায়িত্ব । ক্ষমতার বহর এতটাই ছিল যে শাহজাহান বাইরে বেরোনোর সময় সামনে-পিছনে 50টি করে মোটরবাইক থাকত । এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, বসিরহাটে নুসরত জাহানকে জেতাতে সব থেকে বেশি 'খেটেছিল' এই শাহজাহানই ।
লোকসভা নির্বাচনের আগে বসিরহাট কেন্দ্রের BJP প্রার্থী সায়ন্তন বসু শাহজাহানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, "শাহজাহান হোক বা ঔরঙ্গজেব, এখানে বুথ দখল করতে এলে CRPF-কে বলব, গুলি পায়ে নয়, যেন বুকে গিয়ে লাগে।"
এই সংক্রান্ত খবর :থমথমে সন্দেশখালি : রাস্তায় সতেজ কার্তুজের খোল
তবে, অভিযোগ উঠলেও শাহজাহানের পাশেই রয়েছে তৃণমূল । উত্তর 24 পরগনার জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, "ঘটনার সময় শাহজাহান কোথায় ছিল, সেটা না জেনেই ওরা এই সব অভিযোগ করছে । ওরা আরও একশো জনের নাম দিক ।"
দলগতভাবে আপনারা কি শাহজাহানের পাশে থাকছেন ? এর উত্তরে জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, "অবশ্যই থাকব। একশোতে একশোভাগ থাকব।"