মধ্যমগ্রাম, 10 সেপ্টেম্বর: 'অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো ৷ সেই তো তোমার আলো ৷ সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো ৷ সেই তো তোমার ভালো...' তাঁরা প্রত্যেকেই দৃষ্টিহীন ৷ কেউ জন্মগত অন্ধত্বে । কেউ আবার দুর্ঘটনায় চিরতরে হারিয়েছেন দু'চোখের আলো । এমনই প্রায় 100 জন দৃষ্টিহীন যুবক-যুবতী এবার ব্রতী হলেন মানব সেবায় । রক্তদান করে বুঝিয়ে দিলেন,তাঁরাও সমাজে কোনও অংশেই কম নয় ! সুস্থ,সাবলীল আর পাঁচজনের থেকে দৃষ্টিহীনরাও যে এই সমাজে পিছিয়ে নেই, তারাও বার্তা দিতে চেয়েছেন রক্তদান শিবিরের মতো মহৎ কর্মসূচিতে সামিল হয়ে । শনিবার পরদে পরদে যার সাক্ষী থাকল উত্তর 24 পরগনার মধ্যমগ্রাম । সমাজে ব্রাত্য থেকেও দৃষ্টিহীন এই যুবক-যুবতীরা যেভাবে রক্তদান শিবিরে এসে রক্তদান করলেন তার প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছে খোদ খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষকেও । তিনিও দৃষ্টিহীনদের পাশে থাকার বার্তা নিয়েছেন ।
শনিবার মধ্যমগ্রামের দোলতলার কাছে তন্দ্রা গার্ডেনে দৃষ্টিহীনদের নিয়ে এই রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল 'প্রেরণা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি'-নামে একটি সামাজিক সংগঠন । সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীনদের নিয়ে এমন অভিনব কর্মসূচির আয়োজন করে এই সংগঠন রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সকলকে । অভিনবত্বের আরও বিষয় যেটা এই সংগঠনের সম্পাদক তারক চন্দ্র, নিজেও একজন দৃষ্টিহীন । ফলে, দৃষ্টিহীনদের নিয়ে কিছু করার তাগিদ বরাবরই ছিল তাঁর । সেই তাগিদ থেকেই প্রেরণা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামে একটি সংগঠন খুলে দৃষ্টিহীনদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেন তিনি-সহ সংগঠনের বাকি সদস্যরা । শুধু কী তাই, দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা যাতে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করতে পারেন সেদিকেও নজর দিয়েছেন উদ্যোক্তারা । তার জন্য একটি অডিয়ো লাইব্রেরি-ও চালু হয়েছে সংগঠনের তরফে ।
আরও পড়ুন: তৃণমূলের রক্তদান শিবির বিজেপি নেতার বাড়িতে ! দু'পক্ষকেই নিশানা বামেদের
এছাড়াও দৃষ্টিহীন প্রায় 100 পরিবারকে রেশন সামগ্রী দিয়েও সাহায্য করছেন সংগঠনের সদস্যরা । এতো গেল সংগঠনের কর্মকাণ্ড । দৃষ্টিহীন যুবক-যুবতীরা যারা রক্তদান শিবিরে এসে রক্তদান করে মানব কল্যাণে এগিয়ে এলেন তাঁদের কথায় আসা যাক । শুধুমাত্র রক্তদানের টানে সুদূর মালদা,মুর্শিদাবাদ,বাঁকুড়া-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে ছুটে এসেছেন এই দৃষ্টিহীনরা । ব্যান্ড পার্টি সহকারে তাঁদের রীতিমতো রাজকীয় অভ্যর্থনাও জানানো হয় এ দিন । ফলে, এই ধরণের আয়োজনে স্বভাবতই খুশি দৃষ্টিহীন রক্তদাতারা ।
এই বিষয়ে মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা দৃষ্টিহীন যুবক আলমগীর বিশ্বাস বলেন,"কল্যাণী মহাবিদ্যালয়ে ইতিহাস অনার্স নিয়ে বর্তমানে পড়াশোনা করছি আমি । যার ফলে বাড়ি ছেড়ে আমাকে আপাতত নদিয়ার পায়রাডাঙায় মেসে থাকতে হচ্ছে । আমার রক্ত অসুস্থ একজনের জীবন বাঁচাতে পারে । এটা ভেবেই ভালো লাগছে । পড়ুয়া হলেও মানুষ হিসেবে আমার কিছু না কিছু কর্তব্য রয়েছে সমাজে । তা সত্বেও বলব,রক্তদান নিয়ে এখনও এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে কুসংস্কার রয়েছে । তাঁদের চিন্তাভাবনা,রক্ত দিলে শরীরে রক্ত নাকি কমে যাবে । এই ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল । রক্ত দিলে সেই রক্ত তৈরিও হয়ে যায় শরীরে । এই বদ্ধ ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে । সেই বার্তাও দিতে চাইছি আমরা ৷"
আরও পড়ুন: রাজভবনের রক্তদান শিবিরে তরুণ প্রজন্মের ভিড়
একই সুর শোনা গিয়েছে গিয়াসউদ্দিন মণ্ডল নামে উত্তর 24 পরগনার এক দৃষ্টিহীন বাসিন্দার গলাতেও । তাঁর কথায়, এই নিয়ে 21 বার রক্তদান করেছেন তিনি । যতদিন বাঁচবেন ততদিন রক্তদান শিবিরে এসে রক্তদান করবেন । রক্তের হাহাকার থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়াটাই তাঁর লক্ষ্য । তিনি বলেন, "এটুকু বলতে পারি, আজকের সমাজে আমরাও পিছিয়ে নেই ৷" এ দিকে এই কর্মসূচিতে এসে দৃষ্টিহীনদের এই মহানুভবতার প্রশংসা করে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষ বলেন,"নানা প্রতিবদ্ধকতা থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টিহীনরা যে সমাজে কিছু করতে পারেন, তা তাঁরা রক্তদান শিবিরে এসে রক্তদান করে প্রমাণ করে দিয়েছেন । তাঁদের ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না । নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন দৃষ্টিহীন রক্তদাতারা । আমরা সবসময় তাঁদের পাশে রয়েছি ৷"