বারাসত, 11 অক্টোবর : ইতিহাস সমৃদ্ধ বারাসতে আরও এক ইতিহাস বহন করে চলেছে 'শিবের কোঠা'র পুজো । কালের নিয়মে জৌলুস হারালেও আজও তা অমলিন । 450 বছরের বেশি পুরানো এই পুজোয় সমস্ত উপাচার আজও মানা হয় নিষ্ঠার সঙ্গে । যোধাবাইয়ের আমল থেকে পুজোর শুরু ৷ পুজোর প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা প্রতাপাদিত্যর প্রধান সেনাপতি মহাত্মা শঙ্কর চক্রবর্তী ৷ তারপর তা ধরে রেখেছেন তাঁর বংশধররা ।
এই পুজোর কাঠামোর কোনও পরিবর্তন হয় না । কাঠামোর মূল কাঠ রেখে দেওয়া হয় পরের বছর প্রতিমা গড়ার জন্য । সেই কাঠের সঙ্গে কাঠামো তৈরির আনুসাঙ্গিক জিনিস যুক্ত করে তার উপর প্রতিমা গড়ে তোলেন মৃৎশিল্পী । প্রতিমা তৈরির আগে কাঠামোর পুজো হয় ৷ এটাই বারাসত দক্ষিণ পাড়ার ঐতিহ্যবাহী শিবের কোঠার পুজোর মূল বৈশিষ্ট্য । প্রাচীন এই পুজোর ক'টা দিন আনন্দে মেতে ওঠেন পাড়া-প্রতিবেশী । সামিল হন বহু ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ।
পুজোর সূচনা হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে মহাত্মা শঙ্কর চক্রবর্তীর হাত ধরে । তিনি ছিলেন বঙ্গসূর্যের মহারাজা প্রতাপাদিত্যের প্রধান সেনাপতি । কথিত আছে, ষোড়শ শতকে মোঘল সম্রাট আকবরের হাতে বন্দি হন মহারাজা প্রতাপাদিত্য ও তাঁর প্রধান সেনাপতি শঙ্কর । সেই সময় যশোর থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দিল্লিতে । বন্দি দশায় মহাত্মা শঙ্কর মহালয়ার দিন তর্পণ করার অনুমতি চান আকবরের স্ত্রী যোধাবাইয়ের কাছে । তিনি সেকথা বলেন তাঁর স্বামী সম্রাট আকবরকে । তাঁর অনুমতিতে মহালয়ার দিন তর্পনের মন্ত্রোচারণ করেন শিবভক্ত শঙ্কর । সেই মন্ত্রে মুগ্ধ হন যোধাবাই ৷ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় বন্দি দশা থেকে । এরপর মহাত্মা শঙ্কর চলে আসেন বারাসতের দক্ষিণ পাড়ায় । সেখানেই তিনি শিবের পুজোর সঙ্গে শুরু করেন মা দুর্গার পুজোও । সেই থেকেই এখানে পুজো করে আসছেন মহাত্মা শঙ্করের বংশধররা । আগে পুজোয় পাঁঠা বলি হলেও এখন তার পরিবর্তে আখ এবং কুমড়ো বলি হয় । তবে পুজোর অন্যান্য উপাচারে কোনও বদল ঘটেনি । আজও সেই সমস্ত রীতিনীতি বহন করে চলেছেন মহাত্মা শঙ্করের উত্তর প্রজন্ম ।
বর্তমান বংশধর মুকুল চট্টোপাধ্যায় বলেন, "জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজো করেই প্রতিমা গড়ার কাজে হাত দেন মৃৎশিল্পী । মহালয়ার আগের দিন প্রতিমা গড়ার কাজ সম্পন্ন করা হয় । সেদিনই ঠাকুর দালানে প্রবেশ করাতে হয় উমাকে । কারণ, দেবীপক্ষের সূচনার প্রতিপদ থেকেই পুজো শুরু হয়ে যায় এখানে । পঞ্চমী পর্যন্ত চণ্ডীপাঠ চলে এই পুজোয় । ষষ্ঠীতে বোধন করা হয় মা দুর্গাকে । সপ্তমীতে মায়ের চক্ষুদান ও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় । অষ্টমী, নবমীতে সাড়ম্বরে পুজোয় অংশ নেন সকলে । দশমীতে স্থানীয় পুকুরে উমাকে বিসর্জনের পর সত্যনারায়ণের পুজো দেওয়া হয় । এরপর শুরু হয় দশমীর বিজয়া ৷"
টুম্পা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে অপর এক বংশধর বলেন, "করোনা আবহে পুজো হওয়ায় পরিবারের হয়তো সকলে এই পুজোয় সামিল হতে পারছেন না ঠিকই । তবে পুজোর আচার, রীতিতে কোনও রকম ছেদ পড়েনি । বংশক্রম অনুযায়ী যেভাবে পুজোর উপাচার হয়ে আসছে আজও অমলিন একইভাবে । সপ্তমীতে হাঁড়িকাঠ বসে এখানে । অষ্টমীর দিন পরিবার এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের নিরোগ কামনায় ধুনো পোড়া দেওয়া হয় । তাতে অংশ নেন বয়স্ক মহিলারা । জৌলুস হারালেও পুজোর নিয়ম-কানুনে যাতে কোনও ত্রুটি না হয় সেদিক বজায় রাখার চেষ্টা করি আমরা ৷"
এই পুজোর মৃৎশিল্পী প্রবীর হালদার বলেন, "এখানে মা দুর্গা সম্পূর্ণ সাবেকি রূপে । এভাবেই পূজো হয়ে আসছে এখানে । নতুনত্বের কোনও বিষয় এখনও আসেনি । সাবেকি প্রতিমায় বজায় রাখা হয়েছে । যেহেতু মহালয়ার আগের দিন প্রতিমা গড়ার কাজ সম্পন্ন করতে হবে, সেই কারণে তিনমাস আগে থেকেই প্রতিমা গড়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয় ৷"
আরও পড়ুন : Bankura Durga Puja: আভিজাত্যে মোড়া মোগলদের পাঞ্জাধারী বাঁকুড়ার মালিয়াড়া রাজবাড়ির পুজো