পুরুলিয়া, 19 জানুয়ারি : ভোটের এখনও মাসখানেক বাকি । দিনক্ষণও চূড়ান্ত হয়নি । কিন্তু এখন থেকেই নন্দীগ্রামে নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করে কার্যত ভোটের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । বলতে গেলে, এই নন্দীগ্রাম থেকেই মোড় নিয়েছিল তৃণমূল সুপ্রিমোর রাজনৈতিক জীবন । সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের হাত ধরেই বাংলার তখতে এসেছিলেন তিনি । সেখান থেকে দাঁড়িয়ে, নন্দীগ্রাম 'লাকি জায়গা' তো বটেই । সেখান থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছাও খুব একটা 'অনধিকার প্রবেশ' নয় । কিন্তু তাহলে কেন এত তর্ক-বিতর্ক ? 'নিন্দুকেরা' কেনই বা বলছেন নেত্রী ভয় পেয়েছেন ?
সমস্যাটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রামের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে নয় । নন্দীগ্রামকে যে তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ভালোবাসার জায়গা, তা ঘোর বিরোধীর স্বীকার করতে দু'বার ভাববেন না । কিন্তু সমস্যাটা হল রাজ্য-রাজনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি । একে তো উনিশের লোকসভা ভোটে বিজেপির লম্বা লাফ । তার উপর শুভেন্দু-শোভন থেকে শুরু করে একের পর এক নেতা ঘাসফুল ছেড়ে পদ্মশিবিরে চলে যাচ্ছেন । এই পরিস্থিতিতে 'অগ্নিকন্যা' বেশ স্নায়ুর চাপে আছেন বলেই মনে করছেন রাজ্য-রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা ।
তাই হয়ত, বাংলার তখতে এক দশক পার করার পরেও আজ বেশ নড়বড়ে লাগছে তৃণমূল নেত্রীকে । আর পাঁচটা জনসভায় আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে ছবিতে দেখি সেই ছবি আজ অনেকটাই ম্লান । সেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় তর্জন-গর্জন আজ যেন অনেকটাই ফ্যাকাশে । গতকাল নন্দীগ্রামের পর আজ পুরুলিয়ায় জনসভা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের । আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের দিক থেকে দেখলে, পুরুলিয়া বেশ চাপে ফেলতে পারে রাজ্যের শাসক দলকে । অন্তত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই এটা মনে করছেন । কারণ, শেষ নির্বাচনে পুরুলিয়ায় চাগিয়ে উঠেছে গেরুয়া শিবির । কিছুটা হলেও শক্তি হারিয়েছে মমতার দল । শুধু লোকসভা নির্বাচন নয়, পঞ্চায়েত ভোটেও এখানে রাজ্যের শাসক দলকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছিল বিজেপি ।
আরও পড়ুন : মমতা রাজনৈতিক ভাবে হতাশাগ্রস্ত : শুভেন্দু
সেই সব দিক মাথায় রেখে, পুরুলিয়াবাসীকে কাছে টানতে বেশ গুছিয়ে কেন্দ্রের একের পর এক নীতির সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো । হঠাৎ তাল কাটল । ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকজন বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন । মেজাজ হারালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । ভাষণও থমকে গেল মাঝপথে । সভার মাঠেই বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর প্রশিক্ষক চুক্তিভিত্তিক কর্মীর । বক্তব্য ছিল, তাঁরা কাজের ভিত্তিতে টাকা পান, কোনও মাসিক বেতন নেই । নিজেদের এই অভাবের কথাই মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে পেয়ে জানাতে চেয়েছিলেন ওঁরা ।
কিন্তু কেন মেজাজ হারালেন মুখ্যমন্ত্রী ? বললেন বিজেপি নাকি পরিকল্পনা করে 'ডিস্টার্ব' করতে লোক পাঠিয়েছে তাঁর সভায় । সভামঞ্চ থেকেই হুঁশিয়ার করে দেন বিজেপিকে । বলে দেন, এবার থেকে তিনিও লোক পাঠাবেন 'ডিস্টার্ব' করতে ।
কিছুক্ষণ পরে অবশ্য শান্ত হন নেত্রী । সুর নরম করেন । কিছুটা বাড়ির গুরুজনদের মতো করেই বললেন, "বকেছি বলে কিছু মনে করো না ।" কেঁদেও ফেললেন । যাঁরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, তাঁদের সমস্যার সমাধানের আশ্বাসও দেন ।
আরও পড়ুন : আপনাকে নন্দীগ্রামেই দাঁড়াতে হবে, দু'জায়গায় দাঁড়ালে চলবে না: শুভেন্দু
তৃণমূল নেত্রীর এই ছবিটা আজ যখন সামনে আসে, তখন আরও একটি ছবি উঠে আসে ইতিহাস খুঁড়ে । এই রকমই সভা চলছে নেত্রী । ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করেছিলেন । সেদিনও তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে পেয়ে জানাতে চেয়েছিলেন তাঁর অসন্তোষের কথা । পরিবর্তে মিলেছিল মাওবাদী তকমা ।
সেই মুখ্যমন্ত্রী আর আজকের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে যেন আকাশ পাতাল ফারাক । তবে কি সত্যিই বিজেপি হাওয়াকে কিছুটা ভয় পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী ? একের পর এক নেতারা দলত্যাগী হওয়ায় সত্যিই কি কিছুটা স্নায়ুর চাপে রয়েছেন ? নিজেকে ব্যাকফুটে মনে করেই কি তবে সুর নরম করছেন তৃণমূল নেত্রী ? এই প্রশ্নই এখন ঘোরাফেরা করছে রাজ্য-রাজনীতির আনাচে কানাচে ।
বিরোধীদের মুখেও সেই একই সুর । সিপিএম-এর সূর্যকান্ত মিশ্র বলছেন, "বিজেপি এখন তৃণমূল হয়ে গিয়েছে ৷ তৃণমূলই এখন বিজেপিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ৷ তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় ? পার্থক্য এটাই যে লোকগুলো এদিকে ছিল ওদিকে গিয়েছে ৷ অপেক্ষা করুন, শেষমেশ মুখ্যমন্ত্রীই না চলে যান বিজেপিতে ৷"