কোলাঘাট, 30 সেপ্টেম্বর : স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয় কোলাঘাটের ইলিশের চাহিদা বরাবরই থাকে তুঙ্গে । এ'বছরও সেই চাহিদার কমতি নেই । কিন্তু রূপনারায়ণ নদের দূষণ বাড়ছে । পাশাপাশি গভীরতা হ্রাস পাওয়ায় মুখ ফিরিয়েছে ইলিশের ঝাঁক । মৎস্যরসিকরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন , তেমনই সংকটে পড়েছেন রূপনারায়ণের উপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরাও ।
এক সময়ে বর্ষার সময়ে উপার্জন থেকে সারা বছর সংসার চালাতেন মাঝিরা । বর্তমানে ইলিশের আকালে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা । সংকট থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের কাছে আর্জি জানাচ্ছেন মৎস্যজীবীরা । নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করলে এবং গভীরতা বৃদ্ধি করলে হয়তো আবার সোনালি দিন ফিরতে পারে ।
20-25 বছর আগেও রূপনারায়ণ নদের পাড় ইলিশ বিক্রির জন্য গমগম করত । প্রায় কয়েকশ' মৎস্যজীবী রূপনারায়ণের রুপোলি ইলিশ তুলেই দিন গুজরান করতেন । কয়েক বছর ধরেই ছবিটা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে । দিনের পর দিন কোলাঘাট শহর ও বিভিন্ন এলাকার বর্জ্য নদীতে মিশে দূষণ ও পলি জমে । নদীর গভীরতা কমে যায় । বঙ্গোপসাগর থেকে নদীর অভিমুখে ইলিশের ঝাঁক মুখ ফেরায় । তাই ধীরে ধীরে কোলাঘাটের ইলিশের সোনালি দিন হারাতে বসেছে । মাঝিরা জানাচ্ছেন, কখনও শূন্য হাতেও ফিরতে হচ্ছে তাঁদের । ফলে কর্মী-সহ নৌকার খরচ জোগাড় করতেই বিপাকে পড়েছেন তাঁরা । খরচ ও পেশা বাঁচাতে এখন রূপনারায়ণে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের নিয়েই মৎস্য শিকারে বের হন মাঝিরা । বিকল্প আয়ের সন্ধানে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন আগেই । বর্তমানে 10 থেকে 12 জন মাঝি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন । তাঁরা কিছু কর্মী নিয়ে এখনও ইলিশের সন্ধানে হাতড়ে বেড়ান রূপনারায়ণের বুকে ।
আদৌ কি কোলাঘাটের ইলিশের বর্তমান চাহিদা ফের পূরণ করা সম্ভব ? মাঝিদের বক্তব্য, যদি প্রশাসনের উদ্যোগে নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও ড্রেজ়িং করে নদীর গভীরতা বাড়ানো যায় । তবে ফের ঝাঁকে ঝাঁকে রূপনারায়ণের অভিমুখে সমুদ্র থেকে ছুটে আসতে শুরু করবে ইলিশ । স্বল্পমূল্যে বাঙালির পাতে পৌঁছে যাবে রূপালি শস্য ।
প্রায় 30 বছর ধরে রূপনারায়ণের বুকে নিজের নৌকো নিয়ে মাছ ধরে আসছেন প্রশান্ত খাঁড়া । তিনি জানাচ্ছেন, আগে কুইন্টাল কুইন্টাল ইলিশ এই নদীতেই ধরেছি । কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে নদীতে ইলিশ ও অন্যান্য মাছের আকাল দেখা দিয়েছে । দূষণ ও নদীতে চড়া পড়ে যাওয়ায় কারণেই এই সমস্যা তৈরি হয়েছে । এছাড়া সমুদ্রে প্রচুর পরিমানের ট্রলার বেড়ে যাওয়ায় ইলিশের গতিপথ বাধা পাচ্ছে । নদীর দিকে না এসে মাছ গভীর সমুদ্রে চলে যাচ্ছে । ফলে আমরা সমস্যায় পড়েছি ।
অপর মৎস্যজীবী অমিত খাঁড়ার বক্তব্য, আগে কেবলমাত্র বর্ষার সময় যে ইলিশ শিকার করা হত তা বিক্রি করেই সারা বছর আমরা সংসার চালাতাম । কিন্তু দুই থেকে তিন বছরে ইলিশের দেখা সেভাবে পাওয়া যায়নি । কখনও একটা আবার কোনও কোনওদিন খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে । একটা নৌকা ইলিশ ধরার জন্য প্রস্তুত করতে প্রায় সত্তর আশি হাজার টাকা খরচ হয় । মাছ সেভাবে না ধরা পড়ায় দিনের পর দিন আমাদের লোকসান হচ্ছে । আগে 50-60 জন মাঝি এই পেশায় থাকলেও সংসার চালাতে বাধ্য হয়েই পেশা পরিবর্তন করে নিয়েছে । কেবলমাত্র আমরা 10-12জন এখন নদীতে মাছ ধরি । তাতেও আমাদের সংসার ঠিকঠাক চলছে না । প্রশাসনের তরফে যদি নদীর ড্রেজ়িং ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । না হলে আমাদেরও অদূর ভবিষ্যতে হয়ত অন্য পেশায় চলে যেতে হবে ।
কেন কোলাঘাটের ইলিশের চাহিদা এতটা বেশি? ক্রেতা অসীম দাস জানাচ্ছেন, রূপনারায়ণ নদের ইলিশের স্বাদ ও গন্ধ অন্যান্য জায়গার ইলিশের তুলনায় অনেক বেশি । বাড়িতে রান্না করলে তার সুগন্ধ পাড়াতেও ছড়িয়ে পড়ে । বেশ কয়েকদিন ধরে বাজারে ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি । কিন্তু পাইনি । তাই আজ নৌকাতেই উঠে পড়েছি যদি একটাও ওঠে । যা টাকা হয় তাই দিয়েই কিনব । প্রয়োজনে ধারদেনাও করতে রাজি আছি । না হলে কোলাঘাটের ইলিশ আমাদের কাছে স্বপ্ন আর গল্প কথা হয়ে যাবে । অপেক্ষায় রয়েছি দেখা যাক আজ ভাগ্যে জোটে কি না?
চাহিদার তুলনায় যোগান কম । অভাব এতটাই ক্রেতাদের হাতে ইলিশ তুলে দিতে ব্যবসায়ীরা এখন মাছের বুকিং করেন ফোনের মাধ্যমে । কিন্তু কেন ? ব্যবসায়ী বাসুদেব খাঁড়ার বক্তব্য, আগে রূপনারায়ণে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ উঠত । আমরা 200 থেকে 300 টাকাতেই সেই ইলিশ ক্রেতাদের হাতে তুলে দিতে পারতাম । কিন্তু এখন দিনে একটা থেকে দুটো ইলিশ ওঠে । ক্রেতারা প্রতিদিনই ভিড় করেন দোকানে । দিতে পারি না কারণ আমরাই জানি না কবে নৌকাতে ইলিশ উঠবে । ক্রেতাদের নিজেদের ফোন নাম্বার দিয়ে দিই । ওঁদের ফোন নাম্বারও আমরা কাছে রাখি । ইলিশ পেলে ফোন করে জানাই । গ্রাহকরা দাম দরে পোষালে নিয়ে যান । তবে সেই দাম প্রায় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার । কখনও ওজন বেশি হলে তিন হাজারও ওঠে ।
আদৌ কি ইলিশকে ফের রূপনারায়ণে ফেরানো সম্ভব ? মৎস্যজীবীদের দাবি মেনে নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দিয়েছেন কোলাঘাট ব্লকের ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক মদন মণ্ডল । তিনি বলেন, "আমরা নদীর দূষণ কমানোর জন্য সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন করব । যাতে তাঁরা অব্যবহৃত প্লাস্টিক এবং নোংরা আবর্জনা নদীতে না ফেলেন । আশা করি সচেতনতা বাড়লে দূষণ কমানো সম্ভব । তবে নদীর গভীরতা বাড়ানোর উদ্যোগ ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া সম্ভব নয় । আমরা জেলা প্রশাসনকে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করব ।"