নন্দীগ্রাম, 31 মার্চ : প্রতিবার ভোটের আগে বাংলার রাজনীতিতে আলাদা মাত্রা নিয়ে আসে নন্দীগ্রাম ৷ 2007 সাল ৷ 14 মার্চ ৷ নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গ যতবার উঠে আসে, ততবার এই তারিখটার কথাও যেন একইসঙ্গে উঠে আসে ৷ প্রায় হাজার তিনেক পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল নন্দীগ্রাম ৷ সশস্ত্র পুলিশ ৷ সঙ্গে ছিল পুলিশের উর্দি গায়ে হাওয়াই চটি পরা কিছু মানুষ ৷ তাঁরাও সশস্ত্র ৷ সেদিন শাসকদলের রক্তচক্ষুর সামনে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত 14 জন ৷
2011 সালে রাজ্যে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার পিছনে বড় অবদান রয়েছে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ৷ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের হাত ধরে অবসান ঘটেছিল চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের ৷ তবে নন্দীগ্রামে তৃণমূলের উত্থানের শুরু হয়েছিল 2009 সালের উপনির্বাচন দিয়ে ৷ তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন ফিরোজা বিবি ৷ পেয়েছিলেন 93022 টি ভোট ৷ হারিয়েছিলেন সিপিআই প্রার্থী প্রমানন্দ ভারতীকে ৷
এরপর 2011 সালের বিধানসভা নির্বাচন ৷ ফের একবার তৃণমূলের হয়ে দাঁড়ালেন ফিরোজা বিবি ৷ পেয়েছিলেন 1,03,300 ভোট ৷ ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেননি বামেরা ৷ সিপিআই পেয়েছিল 59,660 টি ভোট ৷ আর বিজেপির পকেটে মেরে কেটে 5813 টি ভোট ৷
এরপর দেখতে দেখতে আরও পাঁচটা বছর পেরিয়ে যায় ৷ 2016 সাল ৷ আরও একটা বিধানসভা ভোট ৷ শুভেন্দুকে দিল্লি থেকে বাংলার রাজনীতিতে নিয়ে আসেন মমতা ৷ প্রার্থী করেন নন্দীগ্রামে ৷ মার্জিন আরও বাড়িয়ে দিলেন শুভেন্দু অধিকারী ৷ জয়ী হলেন 1, 34, 623 ভোটে ৷ সিপিআই পেয়েছিল 53, 393 ভোট ৷ এবার নিজেদের ভোট প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে নেয় বিজেপি ৷ 10,713 টি ভোট পড়েছিল পদ্মে ৷
উনিশের লোকসভা ভোটে আরও কিছুটা ক্ষমতা বাড়িয়েছে বিজেপি ৷ সেদিনের লড়াই-আন্দোলনের পর গিয়েছে 14 বছর ৷ শিয়রে আরও একটা ভোট ৷ বিগত এক দশকের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি মমতা ৷ নিজেকে ফের একবার প্রমাণ করার লড়াই বাংলার অগ্নিকন্যার ৷ লড়ছেন নন্দীগ্রাম থেকে ৷ আর তাঁর বিপরীতে শুভেন্দু ৷ লড়াইটা তাঁরও, নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করে নেওয়ার লড়াই ৷
আরও পড়ুন : কোন পতাকা উড়বে এবার মঙ্গলকোটের মাটিতে ?
যে বামেদের একসময় নন্দীগ্রামের মাটি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, নতুন উদ্যমে লড়ছে তারাও ৷ হারানো মাটি ফিরে পেতে বামেদের বাজি তরুণ তুর্কি মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ৷ ছাত্র-যুব আন্দোলনে সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকলেও সংসদীয় রাজনীতিতে এই প্রথমবার ৷ দুই হেভিওয়েটের মাঝে নজর থাকছে তাঁর দিকেও ৷ প্রচারও করছেন জোরকদমে ৷ নন্দীগ্রামে মীনাক্ষীর হয়ে জনসংযোগে এসেছিল বামেদের হাল্লাগাড়ি ৷ এসেছিলেন বাদশা, শ্রীলেখার মতো বামপন্থী শিল্পীরাও ৷
আন্দোলনের আঁতুড়ঘর নন্দীগ্রাম । নন্দীগ্রাম থেকে ভূমি আন্দোলন করে রাজ্যের পালাবদল হয়েছিল । দীর্ঘ 34 বছরের বাম রাজত্বকে শেষ করে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল । তৎকালীন এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মমতা ৷ আর মমতার প্রধান সেনাপতি ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী । মাঝে হলদি নদী দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে ৷ শুভেন্দু আজ আর মমতার সেই বিশ্বস্ত সেনাপতি নেই ৷ একেবারে বিরোধী পক্ষে ৷ অনেকে মনে করছেন, লড়াইয়ে জিতলে হয়ত নীলবাড়ির চোদ্দতলাতে তিনিই গিয়ে বসবেন ৷
এগারোর ভোটে মমতার সরকার গঠনে অনুঘটকের মতো কাজ করেছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলন ৷ প্রতিশ্রুতির বন্যাও বইয়ে দিয়েছিলেন নেত্রী ৷ সেদিন মমতার পাশে ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারী ৷ পরিবর্তনের এক দশক পেরিয়ে শিয়রে আরও একটা ভোট ৷ কিন্তু এবার নন্দীগ্রামের মানুষের ভরসার দাদা আর নেই দিদির পাশে ৷ আজ লড়াইটা দিদি বনাম দাদার ৷ কাজ হয়েছে বলছেন অনেকে ৷ কিন্তু পাশাপাশি অভিযোগ রয়েছে কর্মসংস্থান নিয়েও ৷ সেভাবে শিল্পও আসেনি ৷ সবমিলিয়ে মিশিয়ে অনেক জায়গাতেই ক্ষোভ জমেছে মানুষের মনে ৷
আরও পড়ুন : এক দশকের সবুজ গড় ধরে রাখতে মরিয়া তৃণমূল, ত্রিমুখী লড়াই রায়দিঘিতে
সব নজর এখন নন্দীগ্রামে ৷ বাকি আর তিন দিন ৷ বৃহস্পতিবার ইভিএম বন্দি হবে নন্দীগ্রামের মানুষের রায় ৷ বাড়ছে স্নায়ুর চাপ ৷ আর তাই গত রবিবার থেকেই নিজের কেন্দ্রে পৌঁছে গিয়েছিলেন নেত্রী ৷ ঘর আগে থেকেই ভাড়া নেওয়া রয়েছে ৷ নন্দীগ্রামে ভোট পর্যন্ত ঠিকানা থাকবেন ৷
শুধু ভোট পর্যন্তই নয় ৷ ভোটের পরেও নিজের 'সাধের' নন্দীগ্রামে থেকে যেতে চাইছেন মমতা ৷ নিজেকে নন্দীগ্রামের ঘরের মেয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা আজ যেন বারবার উঠে এসেছে মমতার কথায় ৷ আর সেই চেষ্টা থাকবে নাই বা কেন ৷ নন্দীগ্রামের মাটি শুভেন্দুর কাছে কতটা চেনা, তা বিলক্ষণ বোঝেন মমতা ৷ এটাও বোঝেন, দাদার অনুগামীদের ভোট যদি বিজেপির পক্ষে চলে যায়, তাহলে লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে উঠবে ৷ কিছুদিন আগেই মমতার নামে বহিরাগত পোস্টার পড়েছিল নন্দীগ্রামে ৷ এখন ভোটের আগে যেন সেই বহিরাগত ট্যাগটাই ঘোচানোর চেষ্টা করছেন মমতা ৷
আর চোটের পর নন্দীগ্রাম ফিরেই অধিকারী পরিবারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন মমতা ৷ 14 মার্চের ঘটনায় শুভেন্দুদের উপর আক্রমণ করলেন ৷ নাম না করে নন্দীগ্রামের মানুষকে জানিয়ে দিলেন, সে-দিনের গণহত্যায় পুলিশ ঢোকানোর দায় শুভেন্দু-শিশিরদের ৷ 'বাপ-ব্যাটা'-র অনুমতিতেই নাকি সেদিন পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকেছিল ৷
হতেই পারে মমতা সত্যি কথা বলছেন ৷ কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, এতটা পরে কেন ? নন্দীগ্রাম যে মমতার কাছে যথেষ্টই আবেগের জায়গা, এ-কথা ঘোর মমতা বিরোধীও স্বীকার করতে দ্বিতীয়বার ভাববেন না ৷ তবে কেন এতদিন ধরে নন্দীগ্রামের গণহত্যা নিয়ে এতবড় একটা সত্যি চেপে রেখেছিলেন নেত্রী ? সেটা কি শুধুই শুভেন্দুদের বাঁচানোর জন্য ? আর এখন শুভেন্দু অন্য দলে বলেই কি মুখ খুলছেন ? আর যদি তাই হয়ে থাকে, তবে কি নিজের ভালবাসার নন্দীগ্রাম, যে নন্দীগ্রাম তাঁর জান কবুল লড়াইয়ের সাক্ষী, সেই মাটির সঙ্গে কি ন্যায় করছেন মমতা ?
যদি এমনটাই হয়ে থাকে তাহলে যে নন্দীগ্রামে তিনি নিজেকে ঘরের মেয়ে বলে প্রমাণ করতে চাইছেন, সেই নন্দীগ্রাম কি তাঁকে আপন করে নেবে ? তবে শেষ পর্যন্ত কোন দিকে রায় দেবে নন্দীগ্রাম ? উত্তর মিলবে 2 মে ৷