বর্ধমান , 1 সেপ্টেম্বর : বর্ধমানের প্রাচীন বর্ধিষ্ণু অঞ্চল কাঞ্চননগর । এখানকার পশ্চিমপাড়ায় বিদ্যাভূষণ পরিবারের দুর্গাপুজো প্রায় দেড়শো বছরের পুরানো । মা শুভচণ্ডী এখানে সিংহবাহিনী । এখানে তাঁর মৃণ্ময়ী মূর্তির পুজো হয় । তবে দশমীতে সাধারণ প্রথা মেনে দেবী মূর্তির নিরঞ্জন হয় না বিদ্যাভূষণ পরিবারের পুজোয় । 12 বছর অন্তর মায়ের নিরঞ্জনের প্রথা রয়েছে এখানে ।
তবে এই শুভচণ্ডীর পুজো প্রথম শুরু করেছিল কাঞ্চননগরের পোদ্দার বাড়ি । প্রায় আড়াইশো বছর আগে এখানে দুর্গাপুজো শুরু হয় । দেবীর মৃণ্ময়ী রূপের পুজো করা হত । সেইসঙ্গে ছিল সোনার চার হাতের দুর্গা । তাছাড়া , দেবী মূর্তির সামনে দু'টো ছোটো আকৃতির চণ্ডীর মূর্তি ছিল । এখনও আছে । হঠাৎ-ই একদিন সোনার চার হাতের মূর্তিটি চুরি হয়ে যায় । তারপর পুজোর চারদিন ছাগবলি ও মোষ বলি হত । একবার সেই বলিদানের সময় ওই পরিবারের কেউ মার যান । তারপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় বলিদান প্রথা । তাছাড়া , কলেরায় সেই সময় বহু মানুষ মারা যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে চলে যায় অনেকে । ফলে পোদ্দার বাড়ির পুজো বন্ধ হয়ে যায় । সেইসময় কাঞ্চননগরের পশ্চিমপাড়ায় থাকতেন হরিপদ পাল । পোদ্দারেরা সম্পর্কে হরিপদ পালের মামা ছিলেন । পোদ্দারদের কোনও উত্তরাধিকার না থাকায় হরিপদ পাল নিজের বাড়িতে মাকে প্রতিষ্ঠা করেন । কিন্তু বলিদান প্রথা বন্ধ করে দেন । এরপর হরিপদ পাল তাঁদের সেবাইত বিদ্যাভূষণ পরিবারের হাতে পুজোর ভার তুলে দেন । তারপর থেকেই প্রায় তিন পুরুষ ধরে বিদ্যাভূষণ পরিবারের এই পুজো চলে আসছে ।
এই প্রসঙ্গে বাড়ির রেণুকা বিদ্যাভূষণ বলেন, " পোদ্দার পাড়ায় সোনার দুর্গা ছিল । সেই দেবী মূর্তি চুরি হয়ে যায় । পরে শোনা যায় বলিদান চলার সময় ওই পরিবারের কারও মৃত্যু হয় । পুজো বন্ধ হয়ে যায় । ওই পরিবারের কোনও উত্তরাধিকার না থাকায় , তাদের ভাগনে হরিপদ পাল পুজোর ভার নিয়ে পশ্চিমপাড়ায় চলে আসেন । কিন্তু , তিনি বন্ধ করে দেন বলিদান প্রথা । পরবর্তীকালে বিদ্যাভূষণ পরিবার পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করে । " বাড়ির অপর সদস্য অসিত বিদ্যাভূষণ বলেন , শুভচণ্ডী মা শুভমা নামেই খ্যাত । প্রায় দু'শো বছর আগে এলাকায় কলেরার প্রাদুর্ভাব হলে অনেক মানুষ মারা যায় । বেশিরভাগ মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে যায় । পরে পুজোর দায়িত্ব নেন হরিপদ পাল । পরবর্তীকালে সেবাইত হিসেবে বিদ্যাভূষণ পরিবার পুজোর দায়িত্ব পায় । "
আর এই পরিবারের পুজোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এখানকার দুর্গামূর্তি দশমীতে বিসর্জন করা হয় না । 12 বছর পর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয় । কিন্তু এর কারণ কী ? বিদ্যাভূষণ পরিবারের তরফে প্রথমে সারাবছর ধরে মায়ের সেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল । কিন্তু কয়েক বছর পুজো করার পরে মায়ের অঙ্গহানি হত । তাছাড়া মা খুব জাগ্রত বলে মানা হয় । সেই কারণে বারো বছর অন্তর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । সেই থেকেই 12 বছর অন্তর প্রতিমা বিসর্জন করা হচ্ছে । এমনটাই জানাচ্ছেন বিদ্যাভূষণ পরিবারের অন্যতম সদস্য অসিত বিদ্যাভূষণ ।
বৈষ্ণব মতে এখানে পুজো করা হয় । এখানে আর একটি নিয়ম আছে । কোনও কারণে যদি মায়ের মূর্তিতে রং করার প্রয়োজন হয় , সেক্ষেত্রে কিন্তু কোনও বাইরের শিল্পী প্রতিমায় রং করতে পারবেন না । শিল্পী যদি ব্রাহ্মণ হন তবেই তিনি প্রতিমাকে স্পর্শ করতে পারবেন । অথবা বাড়ির পুরুষদেরই রং করার ভার নিতে হয় । এমনকী , বাড়ির কোন মহিলাও দেবী মূর্তি স্পর্শ করতে পারেন না । 12 বছর অন্তর যখন দেবীর নিরঞ্জন হয় , সেই সময় যখন মাকে বরণ করা হয় তখন তাঁরা মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন ।
এই প্রসঙ্গে বাড়ির বউমা সুচিত্রা বিদ্যাভূষণ বলেন , " মায়ের নিত্যপুজো হয় । যখন রং করার প্রয়োজন হয় , তখন ব্রাহ্মণ শিল্পীকে দিয়ে রং করানো হয় । কিন্তু সারাবছর বাড়ির কোনও মহিলা মাকে স্পর্শ করে প্রণাম করতে পারেন না । মা খুবই জাগ্রত । 12 বছর পরে যখন মাকে বিসর্জন দেওয়া হয় , সেই সময় আমরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি । "