জামালপুর, 23 সেপ্টেম্বর : ফুরিয়েছে জমিদারি । শেষ জমিদার প্রয়াত হয়েছেন বছর দু'য়েক আগে । তবে, ভক্তি, নিষ্ঠা আর ঐতিহ্যের পরম্পরা নিয়েই রয়ে গিয়েছে এই বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো ।
বর্ধমান থেকে জামালপুর-তারকেশ্বর রাস্তা ধরে যাওয়ার পথে রয়েছে শুঁড়ে কালনা । সেই রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই ডানদিকে 99 বিঘা জমির উপর চকদিঘির বিশাল জমিদারবাড়ি । গেট দিয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে বাগানবাড়ির দুর্গামন্দির । জমিদারদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বুন্দেলখণ্ডের শাসকদের বংশধর । 300 বছরেরও বেশি সময় আগে তৎকালীন জমিদার সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের আমলে এই পুজোর সূত্রপাত । প্রথম থেকেই জমিদার বাড়ির দু'টি ভাগ - বাগানবাড়ি ও বড় বাড়ি উভয় জায়গাতেই দুর্গাপুজো হত । পুজোর সময় জমিদারবাড়ির পক্ষ থেকে গ্রামে গিয়ে ঢ্যারা পিটিয়ে গ্রামবাসীদের নিমন্ত্রণ করা হত । বাড়ির মহিলাদের জন্য বিধি নিষেধ ছিল পুজোর আচার অনুষ্ঠানে । ছিল পর্দাপ্রথা । চিকের(পর্দা) আড়াল থেকে সিংহরায় বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতেন অন্দরমহলের সদস্যরা । আজও সেই ধারাই অব্যাহত এই পরিবারে । অন্দরমহল থেকে পর্দা ঘেরা রাস্তা ধরে পুজো দেখতে আসেন বাড়ির মহিলারা ।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে জমিদার সারদাপ্রসাদ সিংহরায়ের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল । তাঁর আমন্ত্রণেই এবাড়ির দুর্গাপুজোসহ অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে আসতেন বিদ্যাসাগর । আবার, পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের 'ঘরে বাইরে' সিনেমার শুটিংও হয়েছিল এই চকদিঘির জমিদারবাড়িতেই ।
রথের দিন কাঠামোয় মাটি তোলার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় তোড়জোড় । বাগানবাড়ি ও বড় বাড়ি - দুই জায়গাতেই দুর্গাপুজো হয় । প্রতিপদ থেকে শুরু হয়ে দশদিন ধরে চলে মায়ের পুজো । প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর আর ছবি তোলা যায় না এবাড়ির দুর্গা প্রতিমার । তিন মহলা জমিদার বাড়ির অন্দরমহল থেকে পুজো মণ্ডপ পর্যন্ত বিস্তৃত চিকের আড়ালে থেকেই পুজো দেওয়ার রীতি বাড়ির মহিলাদের । পুজো শেষে আবার সেই পথেই অন্দরমহলে ফিরে যান তাঁরা । প্রাচীন প্রথা মেনে আজও বাড়ির মহিলারা পর্দার ভিতর দিয়ে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেন ।
তবে, পুজোয় প্রথমে বলিদান প্রথা থাকলেও পরবর্তীকালে তা বন্ধ হয়ে যায় । পরিবর্তে সন্দেশ নিবেদন করা হয় মা দুর্গাকে । অষ্টমীতে ধুনো পোড়ানোর প্রাচীন রীতি অবশ্য রয়ে গিয়েছে এই বাড়ির পুজোয় । চকদিঘির বাগান বাড়ির ম্যানেজার সুশান্ত দত্ত বলেন, "জমিদারের আমলে এখানে মোষ বলি দেওয়া হত । এখন আর তা হয় না । পরিবর্তে মা-কে সন্দেশ নিবেদন করা হয় । মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠার পরে ছবি তুলতে দেওয়া হয় না । নিয়ম মেনে আজও বাড়ির মহিলারা পর্দার ভিতর দিয়ে এসে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে যান ।" বড় বাড়ির ম্যানেজার অচিন্ত্য বিদ বলেন, "প্রায় 300 বছরের পুরানো এই জমিদারবাড়ির পুজো । এখানে প্রতিপদ থেকে দশদিন ধরে চলে পুজো । আগে ছাগল ও মোষ বলি দেওয়া হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায় । পুরানো রীতি অনুযায়ী আজও এখানে ধুনো পোড়ানো হয় ।"