ETV Bharat / state

বহুতল নির্মাণের কোপে ঐতিহ্য! শান্তিনিকেতনে ভাঙা হচ্ছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি - ABANINDRANATH TAGORE

কোপাইয়ের পর বহুতল নির্মাণের কোপে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ৷ শিল্পীর বাড়ি ভাঙার ছবি-সহ গুণীজন ও প্রশাসনের বক্তব্য তুলে ধরলেন ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি ৷

ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে (ইটিভি ভারত)
author img

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Feb 18, 2025, 10:23 PM IST

বোলপুর, 18 ফেব্রুয়ারি: হারিয়ে যেতে বসেছে শান্তিনিকেতনের একের পর এক ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ৷ ভেঙে ফেলা হচ্ছে প্রখ্যাত শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি । যা নিয়ে ক্ষোভ, আক্ষেপ সকলের ৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় আচার্য ছিলেন ৷ তাঁর ছেলে অলকেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে একটি বাড়ি করেছিলেন ৷ যে বাড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেই বাড়িই ভেঙে ফেলা হচ্ছে ৷

তাঁর নামানুসারেই শান্তিনিকেতনের ওই জায়গার নাম হয়েছিল 'অবনপল্লী'। সেই ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিবিজড়িত 'আবাস' নামক বাড়িটি আর কিছুদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । জানা গিয়েছে, সেখানে নাকি বহুতল নির্মাণ হবে ৷ তাইল শিল্পীর বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে ৷ প্রশ্ন উঠছে এভাবেই কি কবির সাধের শান্তিনিকেতন ঠিকাদার, জমি হাঙরদের দখলে চলে যাবে ?

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ভাঙা নিয়ে বিভিন্ন গুণীজন ও কাউন্সিলরের প্রতিক্রিয়া (ইটিভি ভারত)

জানা গিয়েছে, বর্তমানে দীর্ঘদিন এই বাড়িতে কেউ থাকতেন না ৷ তবে এর আগে মাঝে মাঝে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িতে আসতেন । কিছুদিন এখানে থেকে ফিরে যেতেন কলকাতায় ৷ শেষ কবে তিনি এসেছিলেন, সেই বিষয়েও কিছু জানা যায়নি ৷ বাড়িটি তালাবন্ধ অবস্থায় পড়েছিল ৷ তারপর হঠাৎ সেই বাড়ি ভাঙার খবর প্রকাশ্যে আসে ৷ তা শুনেই ক্ষুব্ধ গোটা শান্তিনিকেতন ৷

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির প্রতিবেশীর বক্তব্য:

বিশ্বভারতীর পাঠভবনের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ তথা প্রবীণ আশ্রমিক সুব্রত সেন মজুমদার । যিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির প্রতিবেশী । আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, "অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতে আমি তাঁর ছেলেদের বসবাস করতে দেখেছি ৷ এই বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে । অত্যন্ত হৃদয়বিদারক বিষয় ৷ এই বাড়ির যে পরিকাঠামো, গঠন তা অবন ঠাকুর, অলক ঠাকুরদের চিন্তায় উঠে এসেছে ৷ তাঁর নামানুসারেই এটা 'অবনপল্লী'। আমরা ভাবতেও পারছি না এত সুন্দর এই বাড়ি এভাবে ভেঙে ফেলা হবে । একটা আদর্শের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শ্যাওলার মতো আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে রিসর্ট, হোটেল ৷ শান্তিনিকেতনের যে ইতিহাস আমার মনে হয় আগামী প্রজন্ম এসে আর দেখতে পাবে না ।"

ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আবাস' ভবন ভেঙে ফেলা হচ্ছে (ইটিভি ভারত)

ঠাকুর পরিবারের সদস্যের বক্তব্য:

সুদৃপ্ত ঠাকুরের কথায়, "শান্তিনিকেতনের বহু স্মৃতিই এইভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে ৷ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির আজকের দিনে কোনও মূল্য নেই । জমি ব্যবসায়ীদের কাছে অবনীন্দ্রনাথের বাড়ির চেয়ে জমির দাম অনেক বেশি ৷ নতুন কিছু নয় ৷ বিশ্বভারতীতে আনন্দ পাঠশালার উলটো দিকে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানির কোয়ার্টারও ধূলিসাৎ করা হয়েছে একটা সময় ৷ শান্তিনিকেতনকে একটা অন্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যা আমাদের মতো মানুষের পছন্দ নয় ৷ অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিটাকে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে সেটা মর্মান্তিক ৷ খুব খারাপ লাগছে ।"

বিশ্বভারতীর অধ্যাপকের বক্তব্য:

এসরাজ শিল্পী তথা বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক শুভায়ু সেন মজুমদার বলেন, "খুবই দুঃখজনক ও কষ্টের অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন প্রখ্যাত শিল্পীর যে বাসস্থান, সেটাও আমরা বজায় রাখতে পারলাম না ৷ সেটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে ৷ একজন শিল্পী হিসাবে এটা আমার কাছে বেদনাদায়ক । আমি ভীষণ মর্মাহত । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হবে, আর সেখানে অন্য মানুষ থাকবে এটা ভাবাই যায় না ।"

ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির বর্তমান অবস্থা (ইটিভি ভারত)

তৃণমূল কাউন্সিলরের বক্তব্য:

ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি অভিষেক দত্ত রায়ের কাছে খবর পেয়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি গিয়েছিলেন বোলপুর পৌরসভার 2 নং ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর চন্দন মণ্ডল ৷ তাঁর ওয়ার্ডে শিল্পীর বাড়ি ভাঙা হচ্ছে দেখে তিনি বলেন, "আমি আপনাদের মারফত খবর পেয়ে দেখে এলাম বাড়িটা । এই এলাকায় আরও গুণীজনের বাড়ি রয়েছে ৷ তবে এই বাড়িটি মালিকানাধীন ৷ এটা কারা ভাঙছেন, তাদের বাড়ির ভাঙার জন্য মালিক বলেছেন কিনা এই সমস্ত বিষয় বিস্তারিত খতিয়ে দেখব ৷ বোলপুর পৌরসভার পক্ষ থেকে যদি কিছু করণীয় থাকে করব ৷ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব । তবে আমরা গুরুদেবের আদর্শ বিরোধী কোনও কাজ করব না ।"

ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED
কাটা হচ্ছে শিল্পীর বাড়ির ভিতরের বহু পুরনো গাছও, গেটের বাইরে ভ্যানে তা বোঝাই করার ছবি (ইটিভি ভারত)

শ্রমিকদের বক্তব্য:

বাড়ি ভাঙার কাজে রত শ্রমিকদের জিজ্ঞাসা করা হলেও তাঁরা স্পষ্টভাবে কিছু জানাতে পারেননি ৷ বাড়িটি ভাঙার কাজ তাঁদের দেওয়া হয়েছে সেইমতো তারা নিজেদের কাজ করছে বলে জানান ৷ তবে কার নির্দেশে বা কেন এই বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে তা তাঁরা বলতে পারেননি ৷

প্রসঙ্গত, গত দুই দশক ধরে বোলপুর-শান্তিনিকেতনে জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয় ৷ কখনও ঐতিহ্যবাহী কোপাই নদীর তীর দখল করে নির্মাণ হচ্ছে, কখনও আদিবাসীদের জমি দখল করে গড়ে উঠছে বিলাসবহুল আবাসন, রিসর্ট, রেঁস্তোরা, বহুতল, হোটেল, লজ প্রভৃতি । এই অভিযোগ পেয়েও নির্বিকার প্রশাসন, তারও অভিযোগ বিস্তর ৷ তবে এবার জমি মাফিয়াদের কোপে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী তথা লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ৷ শান্তিনিকেতনে পূর্বপল্লীর শেষে অবনপল্লীতে শিল্পীর এই 'আবাস' নামক বাড়িটি ভেঙে দেওয়ার কাজ চলছে ৷

ABANINDRANATH TAGORE
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এসরাজ বাজানোর মুহূর্তে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ছবিসূত্র : সোশাল মিডিয়া)

শিল্পীর নামানুসারেই এই এলাকার নাম 'অবনপল্লী' হয়েছে ৷ এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে অলকেন্দ্রনাথ ঠাকুর । জীবনের শেষ সময় বেশ কিছুদিন এই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ । পরে তাঁর নাতি অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর থাকতেন ৷ বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে জোরকদমে ৷

জানা গিয়েছে, এখানে বহুতল নির্মাণ হবে ৷ আর এতেই বিতর্ক শুরু হয়েছে । প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে প্রখ্যাত শিল্পীর বাড়ি ভেঙে ফেলার অনুমতি দিল বোলপুর পৌরসভা ও শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ ? শুধু বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে তা নয়, কেটে ফেলা হচ্ছে বড় বড় গাছও ৷ এর পাশেই রয়েছে সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত বৌদ্ধপন্ডিত সুনীতি কুমার পাঠকের বাড়ি ৷ শান্তিনিকেতনে বৌদ্ধ, পালি ভাষার বিভাগ গঠনে যাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য ৷

অন্যদিকে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিশ্বভারতীর প্রথম আচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । 1941 সালে কবির মহাপ্রয়াণের পর 1942 সালে বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় আচার্য হন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তখনও বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি ৷ তবে শান্তিনিকেতনের মানুষজনের কাছে তিনি 'অবন ঠাকুর' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন ।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজভাই গিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ তাঁর ছেলে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্ত্রী সৌদামিনী ঠাকুরের ছোট ছেলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর যোগ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে, কথোপকথন, শিল্পচর্চা প্রভৃতি নিয়ে বহু লেখনী, ইতিহাস রয়েছে । প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখকও ছিলেন ৷ চিত্রকলার মধ্য দিয়ে কাহিনী বর্ণিত শকুন্তলা, রাজকাহিনী, ক্ষীরের পুতুল, ভারত শিল্প, নালক প্রভৃতি কালজয়ী বইয়ের স্রষ্টা ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এই রকম একজন মানুষের বাড়িও বাদ গেল না ৷ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ও স্মৃতি, যা নিয়ে রীতিমতো আক্ষেপ, ক্ষোভ শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক, আশ্রমিক সকলেরই ৷

বোলপুর, 18 ফেব্রুয়ারি: হারিয়ে যেতে বসেছে শান্তিনিকেতনের একের পর এক ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ৷ ভেঙে ফেলা হচ্ছে প্রখ্যাত শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি । যা নিয়ে ক্ষোভ, আক্ষেপ সকলের ৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় আচার্য ছিলেন ৷ তাঁর ছেলে অলকেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে একটি বাড়ি করেছিলেন ৷ যে বাড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেই বাড়িই ভেঙে ফেলা হচ্ছে ৷

তাঁর নামানুসারেই শান্তিনিকেতনের ওই জায়গার নাম হয়েছিল 'অবনপল্লী'। সেই ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিবিজড়িত 'আবাস' নামক বাড়িটি আর কিছুদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । জানা গিয়েছে, সেখানে নাকি বহুতল নির্মাণ হবে ৷ তাইল শিল্পীর বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে ৷ প্রশ্ন উঠছে এভাবেই কি কবির সাধের শান্তিনিকেতন ঠিকাদার, জমি হাঙরদের দখলে চলে যাবে ?

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ভাঙা নিয়ে বিভিন্ন গুণীজন ও কাউন্সিলরের প্রতিক্রিয়া (ইটিভি ভারত)

জানা গিয়েছে, বর্তমানে দীর্ঘদিন এই বাড়িতে কেউ থাকতেন না ৷ তবে এর আগে মাঝে মাঝে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িতে আসতেন । কিছুদিন এখানে থেকে ফিরে যেতেন কলকাতায় ৷ শেষ কবে তিনি এসেছিলেন, সেই বিষয়েও কিছু জানা যায়নি ৷ বাড়িটি তালাবন্ধ অবস্থায় পড়েছিল ৷ তারপর হঠাৎ সেই বাড়ি ভাঙার খবর প্রকাশ্যে আসে ৷ তা শুনেই ক্ষুব্ধ গোটা শান্তিনিকেতন ৷

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির প্রতিবেশীর বক্তব্য:

বিশ্বভারতীর পাঠভবনের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ তথা প্রবীণ আশ্রমিক সুব্রত সেন মজুমদার । যিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির প্রতিবেশী । আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, "অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতে আমি তাঁর ছেলেদের বসবাস করতে দেখেছি ৷ এই বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে । অত্যন্ত হৃদয়বিদারক বিষয় ৷ এই বাড়ির যে পরিকাঠামো, গঠন তা অবন ঠাকুর, অলক ঠাকুরদের চিন্তায় উঠে এসেছে ৷ তাঁর নামানুসারেই এটা 'অবনপল্লী'। আমরা ভাবতেও পারছি না এত সুন্দর এই বাড়ি এভাবে ভেঙে ফেলা হবে । একটা আদর্শের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শ্যাওলার মতো আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে রিসর্ট, হোটেল ৷ শান্তিনিকেতনের যে ইতিহাস আমার মনে হয় আগামী প্রজন্ম এসে আর দেখতে পাবে না ।"

ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আবাস' ভবন ভেঙে ফেলা হচ্ছে (ইটিভি ভারত)

ঠাকুর পরিবারের সদস্যের বক্তব্য:

সুদৃপ্ত ঠাকুরের কথায়, "শান্তিনিকেতনের বহু স্মৃতিই এইভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে ৷ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির আজকের দিনে কোনও মূল্য নেই । জমি ব্যবসায়ীদের কাছে অবনীন্দ্রনাথের বাড়ির চেয়ে জমির দাম অনেক বেশি ৷ নতুন কিছু নয় ৷ বিশ্বভারতীতে আনন্দ পাঠশালার উলটো দিকে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানির কোয়ার্টারও ধূলিসাৎ করা হয়েছে একটা সময় ৷ শান্তিনিকেতনকে একটা অন্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যা আমাদের মতো মানুষের পছন্দ নয় ৷ অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিটাকে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে সেটা মর্মান্তিক ৷ খুব খারাপ লাগছে ।"

বিশ্বভারতীর অধ্যাপকের বক্তব্য:

এসরাজ শিল্পী তথা বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক শুভায়ু সেন মজুমদার বলেন, "খুবই দুঃখজনক ও কষ্টের অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন প্রখ্যাত শিল্পীর যে বাসস্থান, সেটাও আমরা বজায় রাখতে পারলাম না ৷ সেটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে ৷ একজন শিল্পী হিসাবে এটা আমার কাছে বেদনাদায়ক । আমি ভীষণ মর্মাহত । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হবে, আর সেখানে অন্য মানুষ থাকবে এটা ভাবাই যায় না ।"

ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির বর্তমান অবস্থা (ইটিভি ভারত)

তৃণমূল কাউন্সিলরের বক্তব্য:

ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি অভিষেক দত্ত রায়ের কাছে খবর পেয়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি গিয়েছিলেন বোলপুর পৌরসভার 2 নং ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর চন্দন মণ্ডল ৷ তাঁর ওয়ার্ডে শিল্পীর বাড়ি ভাঙা হচ্ছে দেখে তিনি বলেন, "আমি আপনাদের মারফত খবর পেয়ে দেখে এলাম বাড়িটা । এই এলাকায় আরও গুণীজনের বাড়ি রয়েছে ৷ তবে এই বাড়িটি মালিকানাধীন ৷ এটা কারা ভাঙছেন, তাদের বাড়ির ভাঙার জন্য মালিক বলেছেন কিনা এই সমস্ত বিষয় বিস্তারিত খতিয়ে দেখব ৷ বোলপুর পৌরসভার পক্ষ থেকে যদি কিছু করণীয় থাকে করব ৷ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব । তবে আমরা গুরুদেবের আদর্শ বিরোধী কোনও কাজ করব না ।"

ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED
কাটা হচ্ছে শিল্পীর বাড়ির ভিতরের বহু পুরনো গাছও, গেটের বাইরে ভ্যানে তা বোঝাই করার ছবি (ইটিভি ভারত)

শ্রমিকদের বক্তব্য:

বাড়ি ভাঙার কাজে রত শ্রমিকদের জিজ্ঞাসা করা হলেও তাঁরা স্পষ্টভাবে কিছু জানাতে পারেননি ৷ বাড়িটি ভাঙার কাজ তাঁদের দেওয়া হয়েছে সেইমতো তারা নিজেদের কাজ করছে বলে জানান ৷ তবে কার নির্দেশে বা কেন এই বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে তা তাঁরা বলতে পারেননি ৷

প্রসঙ্গত, গত দুই দশক ধরে বোলপুর-শান্তিনিকেতনে জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয় ৷ কখনও ঐতিহ্যবাহী কোপাই নদীর তীর দখল করে নির্মাণ হচ্ছে, কখনও আদিবাসীদের জমি দখল করে গড়ে উঠছে বিলাসবহুল আবাসন, রিসর্ট, রেঁস্তোরা, বহুতল, হোটেল, লজ প্রভৃতি । এই অভিযোগ পেয়েও নির্বিকার প্রশাসন, তারও অভিযোগ বিস্তর ৷ তবে এবার জমি মাফিয়াদের কোপে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী তথা লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ৷ শান্তিনিকেতনে পূর্বপল্লীর শেষে অবনপল্লীতে শিল্পীর এই 'আবাস' নামক বাড়িটি ভেঙে দেওয়ার কাজ চলছে ৷

ABANINDRANATH TAGORE
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এসরাজ বাজানোর মুহূর্তে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ছবিসূত্র : সোশাল মিডিয়া)

শিল্পীর নামানুসারেই এই এলাকার নাম 'অবনপল্লী' হয়েছে ৷ এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে অলকেন্দ্রনাথ ঠাকুর । জীবনের শেষ সময় বেশ কিছুদিন এই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ । পরে তাঁর নাতি অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর থাকতেন ৷ বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে জোরকদমে ৷

জানা গিয়েছে, এখানে বহুতল নির্মাণ হবে ৷ আর এতেই বিতর্ক শুরু হয়েছে । প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে প্রখ্যাত শিল্পীর বাড়ি ভেঙে ফেলার অনুমতি দিল বোলপুর পৌরসভা ও শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ ? শুধু বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে তা নয়, কেটে ফেলা হচ্ছে বড় বড় গাছও ৷ এর পাশেই রয়েছে সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত বৌদ্ধপন্ডিত সুনীতি কুমার পাঠকের বাড়ি ৷ শান্তিনিকেতনে বৌদ্ধ, পালি ভাষার বিভাগ গঠনে যাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য ৷

অন্যদিকে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিশ্বভারতীর প্রথম আচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । 1941 সালে কবির মহাপ্রয়াণের পর 1942 সালে বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় আচার্য হন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তখনও বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি ৷ তবে শান্তিনিকেতনের মানুষজনের কাছে তিনি 'অবন ঠাকুর' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন ।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজভাই গিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ তাঁর ছেলে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্ত্রী সৌদামিনী ঠাকুরের ছোট ছেলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর যোগ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে, কথোপকথন, শিল্পচর্চা প্রভৃতি নিয়ে বহু লেখনী, ইতিহাস রয়েছে । প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখকও ছিলেন ৷ চিত্রকলার মধ্য দিয়ে কাহিনী বর্ণিত শকুন্তলা, রাজকাহিনী, ক্ষীরের পুতুল, ভারত শিল্প, নালক প্রভৃতি কালজয়ী বইয়ের স্রষ্টা ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এই রকম একজন মানুষের বাড়িও বাদ গেল না ৷ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ও স্মৃতি, যা নিয়ে রীতিমতো আক্ষেপ, ক্ষোভ শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক, আশ্রমিক সকলেরই ৷

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.