বোলপুর, 18 ফেব্রুয়ারি: হারিয়ে যেতে বসেছে শান্তিনিকেতনের একের পর এক ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ৷ ভেঙে ফেলা হচ্ছে প্রখ্যাত শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি । যা নিয়ে ক্ষোভ, আক্ষেপ সকলের ৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় আচার্য ছিলেন ৷ তাঁর ছেলে অলকেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে একটি বাড়ি করেছিলেন ৷ যে বাড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেই বাড়িই ভেঙে ফেলা হচ্ছে ৷
তাঁর নামানুসারেই শান্তিনিকেতনের ওই জায়গার নাম হয়েছিল 'অবনপল্লী'। সেই ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিবিজড়িত 'আবাস' নামক বাড়িটি আর কিছুদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । জানা গিয়েছে, সেখানে নাকি বহুতল নির্মাণ হবে ৷ তাইল শিল্পীর বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে ৷ প্রশ্ন উঠছে এভাবেই কি কবির সাধের শান্তিনিকেতন ঠিকাদার, জমি হাঙরদের দখলে চলে যাবে ?
জানা গিয়েছে, বর্তমানে দীর্ঘদিন এই বাড়িতে কেউ থাকতেন না ৷ তবে এর আগে মাঝে মাঝে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িতে আসতেন । কিছুদিন এখানে থেকে ফিরে যেতেন কলকাতায় ৷ শেষ কবে তিনি এসেছিলেন, সেই বিষয়েও কিছু জানা যায়নি ৷ বাড়িটি তালাবন্ধ অবস্থায় পড়েছিল ৷ তারপর হঠাৎ সেই বাড়ি ভাঙার খবর প্রকাশ্যে আসে ৷ তা শুনেই ক্ষুব্ধ গোটা শান্তিনিকেতন ৷
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির প্রতিবেশীর বক্তব্য:
বিশ্বভারতীর পাঠভবনের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ তথা প্রবীণ আশ্রমিক সুব্রত সেন মজুমদার । যিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির প্রতিবেশী । আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, "অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতে আমি তাঁর ছেলেদের বসবাস করতে দেখেছি ৷ এই বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে । অত্যন্ত হৃদয়বিদারক বিষয় ৷ এই বাড়ির যে পরিকাঠামো, গঠন তা অবন ঠাকুর, অলক ঠাকুরদের চিন্তায় উঠে এসেছে ৷ তাঁর নামানুসারেই এটা 'অবনপল্লী'। আমরা ভাবতেও পারছি না এত সুন্দর এই বাড়ি এভাবে ভেঙে ফেলা হবে । একটা আদর্শের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শ্যাওলার মতো আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে রিসর্ট, হোটেল ৷ শান্তিনিকেতনের যে ইতিহাস আমার মনে হয় আগামী প্রজন্ম এসে আর দেখতে পাবে না ।"
![ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/18-02-2025/23570088_wb_thakur.jpg)
ঠাকুর পরিবারের সদস্যের বক্তব্য:
সুদৃপ্ত ঠাকুরের কথায়, "শান্তিনিকেতনের বহু স্মৃতিই এইভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে ৷ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির আজকের দিনে কোনও মূল্য নেই । জমি ব্যবসায়ীদের কাছে অবনীন্দ্রনাথের বাড়ির চেয়ে জমির দাম অনেক বেশি ৷ নতুন কিছু নয় ৷ বিশ্বভারতীতে আনন্দ পাঠশালার উলটো দিকে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানির কোয়ার্টারও ধূলিসাৎ করা হয়েছে একটা সময় ৷ শান্তিনিকেতনকে একটা অন্য রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যা আমাদের মতো মানুষের পছন্দ নয় ৷ অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিটাকে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে সেটা মর্মান্তিক ৷ খুব খারাপ লাগছে ।"
বিশ্বভারতীর অধ্যাপকের বক্তব্য:
এসরাজ শিল্পী তথা বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক শুভায়ু সেন মজুমদার বলেন, "খুবই দুঃখজনক ও কষ্টের অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো একজন প্রখ্যাত শিল্পীর যে বাসস্থান, সেটাও আমরা বজায় রাখতে পারলাম না ৷ সেটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে ৷ একজন শিল্পী হিসাবে এটা আমার কাছে বেদনাদায়ক । আমি ভীষণ মর্মাহত । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হবে, আর সেখানে অন্য মানুষ থাকবে এটা ভাবাই যায় না ।"
![ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/18-02-2025/23570088_wb_demolish.jpg)
তৃণমূল কাউন্সিলরের বক্তব্য:
ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি অভিষেক দত্ত রায়ের কাছে খবর পেয়েই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি গিয়েছিলেন বোলপুর পৌরসভার 2 নং ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর চন্দন মণ্ডল ৷ তাঁর ওয়ার্ডে শিল্পীর বাড়ি ভাঙা হচ্ছে দেখে তিনি বলেন, "আমি আপনাদের মারফত খবর পেয়ে দেখে এলাম বাড়িটা । এই এলাকায় আরও গুণীজনের বাড়ি রয়েছে ৷ তবে এই বাড়িটি মালিকানাধীন ৷ এটা কারা ভাঙছেন, তাদের বাড়ির ভাঙার জন্য মালিক বলেছেন কিনা এই সমস্ত বিষয় বিস্তারিত খতিয়ে দেখব ৷ বোলপুর পৌরসভার পক্ষ থেকে যদি কিছু করণীয় থাকে করব ৷ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব । তবে আমরা গুরুদেবের আদর্শ বিরোধী কোনও কাজ করব না ।"
![ABANINDRANATH TAGORE HOUSE DEMOLISHED](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/18-02-2025/23570088_wb_birbhum.jpg)
শ্রমিকদের বক্তব্য:
বাড়ি ভাঙার কাজে রত শ্রমিকদের জিজ্ঞাসা করা হলেও তাঁরা স্পষ্টভাবে কিছু জানাতে পারেননি ৷ বাড়িটি ভাঙার কাজ তাঁদের দেওয়া হয়েছে সেইমতো তারা নিজেদের কাজ করছে বলে জানান ৷ তবে কার নির্দেশে বা কেন এই বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে তা তাঁরা বলতে পারেননি ৷
প্রসঙ্গত, গত দুই দশক ধরে বোলপুর-শান্তিনিকেতনে জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয় ৷ কখনও ঐতিহ্যবাহী কোপাই নদীর তীর দখল করে নির্মাণ হচ্ছে, কখনও আদিবাসীদের জমি দখল করে গড়ে উঠছে বিলাসবহুল আবাসন, রিসর্ট, রেঁস্তোরা, বহুতল, হোটেল, লজ প্রভৃতি । এই অভিযোগ পেয়েও নির্বিকার প্রশাসন, তারও অভিযোগ বিস্তর ৷ তবে এবার জমি মাফিয়াদের কোপে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী তথা লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ৷ শান্তিনিকেতনে পূর্বপল্লীর শেষে অবনপল্লীতে শিল্পীর এই 'আবাস' নামক বাড়িটি ভেঙে দেওয়ার কাজ চলছে ৷
![ABANINDRANATH TAGORE](https://etvbharatimages.akamaized.net/etvbharat/prod-images/18-02-2025/23570088_wb_bolpur.jpg)
শিল্পীর নামানুসারেই এই এলাকার নাম 'অবনপল্লী' হয়েছে ৷ এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে অলকেন্দ্রনাথ ঠাকুর । জীবনের শেষ সময় বেশ কিছুদিন এই বাড়িতে কাটিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ । পরে তাঁর নাতি অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর থাকতেন ৷ বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে জোরকদমে ৷
জানা গিয়েছে, এখানে বহুতল নির্মাণ হবে ৷ আর এতেই বিতর্ক শুরু হয়েছে । প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে প্রখ্যাত শিল্পীর বাড়ি ভেঙে ফেলার অনুমতি দিল বোলপুর পৌরসভা ও শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ ? শুধু বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে তা নয়, কেটে ফেলা হচ্ছে বড় বড় গাছও ৷ এর পাশেই রয়েছে সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত বৌদ্ধপন্ডিত সুনীতি কুমার পাঠকের বাড়ি ৷ শান্তিনিকেতনে বৌদ্ধ, পালি ভাষার বিভাগ গঠনে যাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য ৷
অন্যদিকে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিশ্বভারতীর প্রথম আচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । 1941 সালে কবির মহাপ্রয়াণের পর 1942 সালে বিশ্বভারতীর দ্বিতীয় আচার্য হন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তখনও বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি ৷ তবে শান্তিনিকেতনের মানুষজনের কাছে তিনি 'অবন ঠাকুর' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন ।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজভাই গিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ তাঁর ছেলে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্ত্রী সৌদামিনী ঠাকুরের ছোট ছেলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর যোগ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে, কথোপকথন, শিল্পচর্চা প্রভৃতি নিয়ে বহু লেখনী, ইতিহাস রয়েছে । প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখকও ছিলেন ৷ চিত্রকলার মধ্য দিয়ে কাহিনী বর্ণিত শকুন্তলা, রাজকাহিনী, ক্ষীরের পুতুল, ভারত শিল্প, নালক প্রভৃতি কালজয়ী বইয়ের স্রষ্টা ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এই রকম একজন মানুষের বাড়িও বাদ গেল না ৷ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ও স্মৃতি, যা নিয়ে রীতিমতো আক্ষেপ, ক্ষোভ শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক, আশ্রমিক সকলেরই ৷