খণ্ডঘোষ, 15 অগস্ট : 1928 সাল । লাহৌরে সাইমন কমিশনের (Simon Commission) বিরোধিতা করে মিছিল করছিলেন লালা লাজপত রাই (Lala Lajpat Rai) । জেমস স্কটের নির্দেশে লালা লাজপত রাইয়ের উপরে লাঠিচার্জ করে ব্রিটিশ পুলিশ । গুরুতর আহত হন তিনি । কয়েকদিন পর মারা যান । খবরটা কানে যায় বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের (Bhagat Singh) । রাজগুরু (Shivaram Rajguru)-সহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে বদলা নিতে গিয়ে ভুল করে স্যান্ডার্সকে (John P. Saunders) হত্যা করেন । সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে পালিয়ে আসেন বর্ধমানের খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামে । ওই গ্রামে বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের (Batukeshwar Dutt) জন্মভিটে । বটুকেশ্বর দত্তের বাড়িতে লুকিয়ে থাকেন ভগৎ সিং । খণ্ডঘোষেও শুরু হয় পুলিশি তল্লাশি ৷ বটুকেশ্বর দত্তের পাশের বাড়ি ছিল ঘোষেদের বাড়ি । ওই বাড়িতে একটি পাতালঘর আছে সেটি বটুকেশ্বর দত্ত জানতেন । বটুকেশ্বর দত্তের সঙ্গে ভগৎ সিং সেই পাতাল ঘরেই আশ্রয় নিয়েছিলেন । সেখানে তাঁরা ছিলেন দিন পনেরো । শোনা যায়, ওই পাতাল ঘরে বসেই দিল্লির গণপরিষদে বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনা করেছিলেন ভগৎ সিং ।
বর্ধমান স্টেশন থেকে 4 কিলোমিটার পথ তেলিপুকুর মোড় । সেখান থেকে আরামবাগের রাস্তা ধরে 4 কিলোমিটার গেলে মিলবে বাঁকুড়া মোড় । বাঁকুড়া মোড় থেকে পশ্চিম দিকে 10 কিলোমিটার গেলে বাঁদিকে পড়বে ওঁয়াড়ি গ্রাম । সেই রাস্তা ধরে প্রায় সাড়ে 3 কিলোমিটার গেলেই মিলবে বটুকেশ্বর দত্তের জন্মভিটে । তার আগের বাড়িটিই ঘোষ বাড়ি নামে পরিচিত ।
প্রাচীন এই বাড়িটির বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়তে শুরু করলেও একবার দেখলেই বাড়িটির গঠন প্রণালী মন টানবে । ওই বাড়ির পুরানো অংশে আর বসবাস করা যায় না ৷ লাগোয়া নতুন বাড়ি বানাতে হয়েছে ঘোষ বাড়ির উত্তর পুরুষদের ৷ পুরানো বাড়ির বারান্দা দিয়ে প্রথম ঘরে ঢুকলেই দেখা যাবে দেওয়াল কেটে দু'দিকে দু'টি শোকেস করা আছে । সেখানে আগে কাঠের পাল্লা দেওয়া ছিল । বাইরে থেকে সেই পাল্লা খুললে দেখা যেত প্রসাধনী সামগ্রী সাজানো আছে । ফলে কিছুতেই বোঝার উপায় ছিল না পাতাল ঘরের পথ । একটা শোকেসের সামনেই থাকত শোবার খাট আর শোকেসের সামনে পর্দা ঝোলানো থাকত । সেই শোকেসের ভিতর দিয়েই ছিল একটা রাস্তা । যেটা নিচের দিকে চলে গিয়েছে । সেখানে অনায়াসে চার-পাঁচজন লুকিয়ে থাকতে পারতেন ।
বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের পরামর্শে ওই পাতাল ঘরে লুকিয়ে থাকেন ভগৎ সিং । শোনা যায়, এই পাতাল ঘরেই ব্রিটিশ গণপরিষদে বোমা ফাটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন ভগৎ সিং । পরে সেখান থেকে তাঁরা বিভিন্ন রাস্তায় দিল্লি পৌঁছন ৷ সেখানে গণপরিষদে ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত এবং অন্যরা 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগান দিতে দিতে বোমা নিক্ষেপ করেন ৷
দিনে দিনে এই ঘোষ বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ছে । সেই ঘোষ বাড়ির বর্তমান বাসিন্দারা চাইছেন সরকার যদি তাঁদের পুনর্বাসন দেয় তাহলে সরকারের হাতে সেই বাড়ি তাঁরা সংরক্ষণের জন্য তুলে দেবেন । বটুকেশ্বর দত্ত সংরক্ষণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বিপ্লবীর বাড়ি সংরক্ষণ করে মিউজিয়াম গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে । তাঁরা চাইছেন, সেই ঘোষবাড়িও তাঁরা হাতে পেলে সেটাকে সংরক্ষণ করা হবে ।
ঘোষ বাড়ির গৃহবধূ রেখা ঘোষ বলেন, "এই বাড়িতে যে একটা পাতাল ঘর রয়েছে সেটা বাইরে থেকে বোঝা যেত না । আমরা চাই সেই বাড়ি সংরক্ষণ করে মিউজিয়াম হিসাবে গড়ে তুলুক সরকার ৷ আমাদের পুনর্বাসন দিলে সেই বাড়ি আমরা ছেড়ে দেব ।"
বটুকেশ্বর দত্ত স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সম্পাদক মধুসূদন চন্দ্র বলেন, "ইতিমধ্যেই বটুকেশ্বর দত্তের বাড়ি সংরক্ষণ করে মিউজিয়াম তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে । ঘোষ বাড়ির সঙ্গেও কথাবার্তা, আলোচনা চলছে । ওই বাড়ি সরকারের হাতে এলে তা সংরক্ষণ করা হবে ।"
ইতিহাসবিদ সর্বজিৎ যশ বলেন, "ওই পাতাল ঘরে 15 দিন ধরে বিপ্লবী ভগৎ সিং আত্মগোপন করেছিলেন । সেখানেই গণপরিষদে বোমা ফাটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল ৷ সেই পরিকল্পনা মতোই দিল্লির গণপরিষদে বোমা ছোড়েন বিপ্লবী ভগৎ সিং । পরে তিনি ধরা দেন । আজ ওই গ্রামে কেউ গেলেই পাতাল ঘরের খোঁজ করেন । ওই পাতাল ঘর সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করার কাজ চলছে ।"
আরও পড়ুন : শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে চাবুক নিয়ে যেতেন ইংরেজদের 'যম' বিমল প্রতিভাদেবী