মেদিনীপুর, 19 ডিসেম্বর : পশ্চিম আকাশটা তখন ক্রমেই লাল হচ্ছে । হাজার হাজার লোকের সামনে ছেলেটাকে বুকে টেনে নিলেন গেরুয়া শিবিরের অন্যতম মূল কাণ্ডারি । পড়ন্ত বেলায় গেরুয়া হয়ে গেলেন ছেলেটা ।
শীতের দুপুরটা যেন মুহূর্তে আরও হিমশীতল হয়ে গেল । অবসান হল সব জল্পনার । তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন শুভেন্দু অধিকারী ।
প্রথমে মমতা-সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ । তারপর একে একে বিধায়ক পদ... তৃণমূলের প্রাথমিক সদস্যপদ... সব ছেড়ে বেরিয়ে আসা । বিজেপি যোগদান ছিল কার্যত সময়ের অপেক্ষা । আজ সেই সময় শেষ হল ।
মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে অমিত শাহর হাত ধরে পদ্মশিবিরের জার্সি গায়ে পরে নিলেন শুভেন্দু । গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নিতেই অমিত শাহর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম শুভেন্দুর । শুভেন্দুকে বুকে জড়িয়ে নিলেন অমিত শাহ । গেরুয়া ব্রিগেডে যোগ দিতেই 'তোলাবাজ ভাইপো' হটানোর ডাক দিলেন শুভেন্দু ।
শুভেন্দুর পাশাপাশি বিজেপিতে যোগ দিলেন ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত, গাজোলের বিধায়ক দীপালি বিশ্বাস, বর্ধমান পূর্বর সাংসদ সুনীল মণ্ডল, উত্তর কাঁথির বিধায়ক বনশ্রী মাইতি, তমলুকের সিপিআই বিধায়ক অশোক দিন্দা, প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ দশরথ তিরকে, মন্তেশ্বরের তৃণমূল বিধায়ক সৈকত পাঁজা, নাগরাকাটার তৃণমূল বিধায়ক সুকরা মুণ্ডা, কর্নেল দীপ্তাংশু চৌধুরি, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হলদিয়ার সিপিআইএম বিধায়ক তাপসী মণ্ডল ।
আরও পড়ুন : মেদিনীপুরের ময়দানেই গেরুয়া শুভেন্দুর নবোত্থান
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, বাংলার রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেই দ্বিতীয় সবথেকে বড় ক্ষমতাবান রাজনৈতিক পরিবার হল অধিকারী পরিবার । একই পরিবারে একই সময়ে দুই সাংসদ , এক বিধায়ক-মন্ত্রী (প্রাক্তন) । বাংলার রাজনীতিতে এমন ছবি সচরাচর দেখা যায় না । সেই দিক থেকে অনেকেই অধিকারীদের বাংলার 'মোস্ট হেভিওয়েট রাজনৈতিক পরিবার' বলে মনে করেন । এই পরিস্থিতি শুভেন্দুকে সরিয়ে তৃণমূল যুবর সভাপতি হিসাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আসাটা মোটেই ভালোভাবে নেননি পূর্ব মেদিনীপুরের দাপুটে এই নেতা । সেই ক্ষোভ থেকেই কি দল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন শুভেন্দু ? শুভেন্দু দল ছাড়লেও দিব্যেন্দু বা শিশিরবাবু আপাতত তৃণমূলেই থাকছেন ।
আরও পড়ুন : দক্ষ সংগঠক হলেও শুভেন্দু কি কোনওদিন মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ছিলেন ?
আজ শুধু মেদিনীপুর নয়, গোটা বাংলার রাজনীতিই যেন ছিল শুভেন্দুময় । আর নতুন ইনিংসের শুরুতেই বিজেপিতে মুগ্ধ শুভেন্দু । বললেন, "বিজেপি বহুত্ববাদে বিশ্বাস করে । দেশের শান অমিতজি ।" কিছুদিন আগেই কোরোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি । সেই সময়ও তৃণমূলের কেউ খোঁজ নেননি বলে আজ নিজের ক্ষোভ উগরে দেন সদ্য গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়া এই নেতা । রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেন, "কোরোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম । যাঁদের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি , তাঁরা আমার খোঁজ নেননি । অমিত শাহ ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলেন সেই সময় ।"
আরও পড়ুন : অধিকারী পরিবারের বিশ্বাসযোগ্যতা আছে ? শুভেন্দুর দলবদলে কটাক্ষ কল্যাণের
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের বিরুদ্ধে নিজের সব জমে থাকা ক্ষোভ আজ প্রকাশ করলেন শুভেন্দু । বললেন, "আত্মসম্মান নিয়ে কেউ তৃণমূলে থাকতে পারে না । আত্মসম্মান আছে বলেই তৃণমূল ছেড়েছি ।" দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় যাঁর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শুভেন্দু ছিলেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ছাড়লেন না । সাফ জানিয়ে দিলেন,"আমার মায়ের নাম গায়েত্রী দেবী । অন্য কাউকে মা বলতে হলে তিনি ভারতমাতা । আর কাউকে 'মা' বলতে পারব না ।"
আরও পড়ুন : তৃণমূল কর্মীদের খোলা চিঠি শুভেন্দুর
এদিকে আজকের শুভেন্দুময় অমিত-সভা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলে নিল পদ্মশিবির । এর আগে যখন বাংলায় এসেছিলেন অমিত শাহ, তখনই বাংলায় 200-র বেশি আসন জয়ের কথা বলে গেছিলেন তিনি । আজ আবার সেই একই কথা বলে গেলেন অমিত শাহ । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে বললেন, "আজ সবে শুরু । ভোট আসতে আসতে আরও হবে । আপনি একা থেকে যাবেন ।" তিনি আরও বলেন, "দিদি, কান খুলে শুনে নিন, বিধানসভা ভোটের ফলাফল এলে দেখে নেবেন, 200-র বেশি আসন নিয়ে বিজেপি সরকার তৈরি করবে ।"
আরও পড়ুন : দক্ষ সংগঠক হলেও শুভেন্দু কি কোনওদিন মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ছিলেন ?
বাংলায় একের পর এক রাজনৈতিক হত্যার যে অভিযোগ বিজেপি করে আসছে, আজ সেই প্রসঙ্গ আরও একবার উসকে দেন অমিত শাহ । বললেন, "আর কতজনকে মারবেন ? দিদি, পুরো বাংলা এবার আপনার বিরুদ্ধে ।" মেদিনীপুরের মাঠ থেকে বাংলায় পরিবর্তনের ডাক দিলেন অমিত-শুভেন্দু ।