ক্ষীরপাই, 14 জানুয়ারি : 1868-র রসগোল্লা স্বীকৃতি পেয়েছে ৷ অথচ 1740-50-এর বাবরসার ভাগ্যে ছিটেফোঁটাও জোটেনি ৷ কিন্তু এই বাবরসার ভাগ্যেই জুটেছে অনেক প্রশংসা ৷ তবুও স্বীকৃতি না পাওয়ায় মুখমিষ্টি আর ধরে রাখতে পারছেন না ক্ষীরপাইয়ের বাবরসা ব্যবসায়ীরা ৷ তারা এখন মুখটা একটু গোমড়া করেই বলছেন, "রসগোল্লা মেডেল পেল ৷ আমাদের বাবরসার কী দোষ ? ও কেন পাবে না ? আমরা বাপু এর শেষ দেখে ছাড়ব ৷"
বাবরসা ৷ নাম শুনেই বোঝা যায় ইতিহাসে মাখোমাখো হয়ে রয়েছে এই মিষ্টি ৷ সালটা 1740-50 এর মধ্যে ৷ শোনা যায়, বর্গীরা সেই সময় একাধিকবার ক্ষীরপাইয়ে আক্রমণ করে ৷ বর্গী হামলার মুখে পড়ে কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়ে এলাকার লোকজন ৷ কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় ৷ সেসময় না কি ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এডওয়ার্ড বাবরস নামের এক সাহেব ৷ তিনিই বর্গীদের এলাকা ছাড়া করেন ৷ স্বস্তি ফেরে এলাকায় ৷ স্বীকৃতিস্বরূপ সাহেবকে এই বিশেষ মিষ্টি উপহার দেন এক ময়রা ৷ সাহেবের নামেই মিষ্টির নামকরণ করা হয় বাবরসা ৷
আবার এই মিষ্টির সঙ্গে জড়িত রয়েছে মোঘল সম্রাট বাবরের নামও ৷ শোনা যায়, বাবরের এক সেনাপতি বর্ধমান যাওয়ার পথে ক্ষীরপাইয়ে ক্যাম্প করেছিলেন ৷ তিনিই না কি এই বিশেষ মিষ্টি নিয়ে গিয়ে বাবরকে খাওয়ান ৷ সেই থেকেই না কি এর নাম বাবরসা ৷ যদিও এই লোককথার ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই ৷
কীভাবে বানানো হয় বাবরসা ?
ডালডা, ময়দা, দুধ, ঘি, জল, মিষ্টির রস ও মধু দিয়ে তৈরি হয় বাবরসা ৷ প্রথমে ডালডা ও ময়দা কিছুক্ষণ ধরে মাখতে হয় ৷ তারপর এই মিশ্রণের মধ্যে দেওয়া হয় পরিমাণ মতো দুধ ও জল ৷ মিশ্রণটি নরম হয়ে গেলে ঘিয়ের উপর ফোঁটা ফোঁটা ময়দা ঢেলে তৈরি হয় বাবরসার নকশা বা আদল ৷ তারপর মধু বা চিনির রসে ঢেলে পরিবেশন করা হয় সুস্বাদু বাবরসা । এক একটির দাম 25 থেকে 30 টাকা ৷
রসগোল্লার সঙ্গে বাবরসা বানানোর প্রক্রিয়ায় বিস্তর ফারাক ৷ স্বাদের তো বটেই ৷ কিন্তু, দুইয়ের মধ্যে মিল প্রাচীনত্বে ৷ যে রসগোল্লাকে নিয়ে এত মাতামাতি তার থেকে বয়সে 100 বছরেরও বেশি ''বড়'' বাবরসা ৷ ইতিহাস অন্তত তাই বলছে ৷ আর এই ইতিহাসকেই ঢাল করে স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে নামতে চাইছে বাবরসা ব্যবসায়ীরা ৷
এই এলাকারই হেভিওয়েট বাবরসা ব্যবসায়ী অশোক বিশ্বাস ৷ প্রায় 80 বছর ধরে বাবরসার সঙ্গে ''ঘর'' করছেন ৷ স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্নে তো কার্যত 'হুঙ্কার' ছাড়লেন তিনি ৷ "দাদু-বাবার বাবরসার দোকান চালানো আমারও তো কম দিন হল না ৷ কে আসেনি বলুন দেখি ৷ জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ শংকর রায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়, মুকুল রায় থেকে শুরু করে বাঘা বাঘা লোকজন এখানকার বাবরসা খেয়েছেন ৷ প্রশংসা ও করেছেন ৷ তাঁরা এলেন, দেখলেন, খেলেন, প্রশংসাও করলেন ৷ ব্যাস ওইটুকুই ৷ যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেল বাবরসা ৷ স্বীকৃতিটুকু পেল না ৷ সরকারের কাছে আবেদন করছি, তারা বিষয়টি দেখুক ৷" আর এক ব্যবসায়ী বললেন, "এত সুস্বাদু বাবরসা আর কোথাও আছে ? খুঁজে দেখুন ৷ পাবেন না ৷ রসগোল্লার আগে থেকেই বাবরসা তৈরি হচ্ছে ৷ রসগোল্লার ভাগ্যে জুটে গেল ৷ আর বাবরসাও স্বীকৃতি পেল না?"
স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে ব্যবসায়ীরা পাশে পেয়েছে ক্ষীরপাই পৌরসভাকে ৷ চেয়ারম্যান দুর্গাশংকর পান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নেমেছেন ৷ স্বীকৃতি আদায়ের জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন করবেন ৷ প্রয়োজনে আরও দূর পর্যন্ত যাবেন, জানিয়ে দিয়েছেন দুর্গাশংকরবাবু ৷
রসগোল্লার নাম দেশজোড়া ৷ জি আই (Geographical Indication) পাওয়ার পর সেই রমরমা আরও বেড়েছে ৷ এই ট্যাগ আন্তর্জাতিক বাজারে রসগোল্লাকে পরিচয় দিয়েছে ৷ ক্ষীরপাইয়ের ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, রসগোল্লার মতোই দেশের নানা প্রান্তে যায় বাবরসাও ৷ GI স্বীকৃতি পেলে বাবরসাও পরিচিতি পাবে বিদেশের বাজারেও ৷