দুর্গাপুর, 23 নভেম্বর: গত 11 বছরে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় প্রায় 32 জন ঠিকা ও স্থায়ী কর্মীর মৃত্যু হয়েছে । গত দু'বছরে মৃত্যু হয়েছে 5 জনের । আর এই কারণে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা (Durgapur Steel Plant) সাম্প্রতিককালে শ্রমিকদের কাছে 'আতঙ্কের কালখানায়' পরিণত হয়েছে ।সারা দেশে যখন বেসরকারি ইস্পাত শিল্পে আধুনিকীকরণ হয়েছে, তখন রাষ্ট্রায়াত্ব লৌহ ও ইস্পাত শিল্পে এই মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণেই কী এতো মৃত্যু ? নাকি শ্রমিকদেরকে নিরাপত্তা সম্পর্কে সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভাব রয়েছে ? এই প্রশ্নগুলিই উঠছে ৷
গত 21 নভেম্বর দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার গরম লোহা চলকে পড়ে ঘটে দুর্ঘটনা (DSP Accident) । এর জেরে এখনও পর্যন্ত দু'জন মারা গিয়েছেন, দু'জন আহত ৷ তাঁদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক । এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে গ্যাস লিক করে কারাখানার দু'জনের মৃত্যু হয়েছিল । এর আগে কখনও গ্যাস লিক, কখনও লোহার কাঠামো বা ক্রেইন থেকে পড়ে, আবার কখনও লোকোতে কাটা গিয়ে বহু শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে (Spate of accidents in last decade) ।
সিটু নেতা সীমান্ত চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, "আমরা দেখছি এখন কারখানা কর্তৃপক্ষের একটাই স্লোগান । উৎপাদন, উৎপাদন আর উৎপাদন । স্বল্প শ্রমিক নিয়ে এটাই চুড়ান্ত লক্ষ্য । কারখানা কর্তৃপক্ষের এই মনোভাবের জন্য শ্রমিকদের জীবন যাচ্ছে । সমস্ত শ্রমিক সংগঠনকে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে ৷ আর শ্রমিকদের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে হবে ।"
"মান্ধাতা আমলে তৈরি হওয়া দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার পরিকাঠামোই আজ বিপদ ডেকে আনছে ৷" এমনই অভিযোগ শাসকদলের ঠিকা শ্রমিক সংগঠনের নেতা শেখ আজিমুদ্দিনের । তাঁর আরও অভিযোগ, "কারখানা কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জেরে বহু কর্মীর প্রাণ গিয়েছে । গত দশ বছরে প্রায় 30 জনের বেশি কর্মীর মৃত্যু হয়েছে । আমরা তৃণমূল ঠিকা শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কারখানা কর্তৃপক্ষের উপর বারবার চাপ সৃষ্টি করেছি, শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য । মৃতদের পরিবারের সদস্যদের স্থায়ী চাকরি এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি আদায় করতে পেরেছি । কিন্তু যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে তাতে সত্যি আমরা আতঙ্কিত ।"
কারখানার ঠিকা শ্রমিক অশোক চট্টোপাধ্যায় বলেন, "এখন কারখানায় এলে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে যেতে পারবো কি না, সেই চিন্তা নিয়েই কাজ করতে হয় । কখনও গ্যাস লিক করে ৷ কখনওব লোহার কাঠামো মাথার উপরে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা চোখের সামনে দেখছি । তাই কারখানা এখন 'কালখানা'তে পরিণত হয়েছে ।"
তৃণমূল ঠিকা শ্রমিক সংগঠনের নেতা শেখ শাহাবুদ্দিন সরাসরি অভিযোগের আঙুল তুললেন কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে । তিনি বলেন," কারখানার নিরাপত্তা বিষয়ে যে গাফিলতি রয়েছে সেগুলির দিকে নজর দিচ্ছে না কারখানা কর্তৃপক্ষ । অথচ জামশেদপুরের টাটার যে লৌহ ও ইস্পাত কারখানা রয়েছে সেখানে রক্তপাতহীন উৎপাদনের দৃষ্টান্ত তৈরি করা হয়েছে । বেসরকারি বহু লৌহ ও ইস্পাত কারখানায় আধুনিকীকরণ করা হয়েছে । আর তার জেরে দুর্ঘটনাকে কমানো গিয়েছে ।"
তাহলে প্রশ্ন উঠছে যে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা 'সেইল'র হাতে লভ্যাংশ তুলে দিচ্ছে, যে ঠিকা কর্মীরা ও স্থায়ী শ্রমিকরা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাকে বজায় রাখতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ কেন কারখানা কর্তৃপক্ষ ?
গত 21 নভেম্বর দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আবার সেই 'গতানুগতিক' তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে ৷ তার জেরে এখনও পর্যন্ত দু'জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে । কিন্তু কারখানায় যেভাবে প্রাণ চলে যাচ্ছে অবলীলায়, তা দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার শ্রমিক মহল ।
আরও পড়ুন: দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল আরও এক ঠিকা শ্রমিকের
সিটু নেতা সীমান্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, "আমরা বিষয়টি ইস্পাত মন্ত্রককে লিখিত আকারে জানিয়েছি । শ্রমিক নিরাপত্তা গাফিলতি কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না । দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় গত এক দশকে যেভাবে লাগাতার দুর্ঘটনার জেরে শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তা কিন্তু শুধু দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার শ্রমিকদের কাছেই আতঙ্কের নয়, শিল্পনগরী দুর্গাপুরের সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি কারখানার কর্মরত শ্রমিক মহলের ও তাদের পরিবারের কাছে যথেষ্ট আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।"