দুর্গাপুর (পশ্চিম বর্ধমান), 4 এপ্রিল: দিনকয়েক আগে ভরসন্ধ্যায় শক্তিগড়ে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে খুন করা হয় এককালে কয়লা মাফিয়া হিসেবে পরিচিত রাজেশ ওরফে রাজু ঝাকে ৷ সেই ঘটনার তদন্তে রাজ্যের তরফে সিট গঠন করা হয়েছে ৷ চলছে তদন্ত ৷ কিন্তু এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ ৷ তবে তদন্তকারীদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন অনেকেই ৷ এই নিয়ে তদন্তকারীরা মুখ না খুললেও দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে একটাই প্রশ্ন মুখে মুখে ফিরছে, বর্তমানের কোনও ঘনিষ্ঠ কিংবা প্রাক্তন কোনও শাগরেদের হাতেই কি খুন হতে হল রাজুকে ?
কেন উঠছে এই প্রশ্ন ? তার কারণ দুর্গাপুর মহকুমার একাধিক কয়লা মাফিয়ার খুনের ঘটনার ইতিহাস৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির গিয়েছে নিহতের খাস লোকের দিকেই ৷ কয়ালঞ্চলের অপরাধের অতীত সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা এই ক্ষেত্রে সেলিম, আমিন ও শাহজাহান নামে তিনমূর্তির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন ৷
শেখ সেলিম দুর্গাপুরের ফরিদপুরের কৈলাসপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন ৷ তাঁর বিরুদ্ধে কয়লাপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল ৷ সেই সময় স্থানীয় দুই যুবক শেখ আমিন ও শেখ শাহজাহান ছিলেন তাঁর ছায়াসঙ্গী ৷ আমিন ও শাহজাহানই সেলিমকে খুন করেন বলে অভিযোগ উঠেছিল ৷ তার পর ওই অঞ্চলে কালো হীরের পাচারে তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন শেষ কথা ৷ পরে খুন হতে হয় আমিনকেও ৷ সেই ঘটনায় সম্প্রতি দুর্গাপুর মহকুমা আদালত আটজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে ৷ সেই আটজনের মধ্যে অন্যতম শাহজাহান ৷ যিনি আমিনের বন্ধু বলে পরিচিত ছিলেন বরাবর ৷
সূত্রের খবর, রাজুর ক্ষেত্রে এই ধরনের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা ৷ কারণ, রাজুর সঙ্গে তাঁর পুরনো সাগরেদ সম্পর্ক ইদানীং ভালো ছিল না বলেই খবর ৷ রানিগঞ্জের এক কয়লামাফিয়ার সঙ্গে নাকি তাঁর বিরোধ ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছিল ৷ ফলে পুরনো শত্রুতার জেরেই রাজুকে নিকেশ করা হয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা ৷
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, রাজুকে মেরে কার কী লাভ হল ? কারণ, একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, 2011 সালের পর থেকে কয়লাপাচারে কর্তৃত্ব কমেছিল রাজুর ৷ সেই সময় এই পাচারে অনুপ মাজি ওরফে লালার নাম সামনে চলে আসে ৷ কয়লাপাচার কাণ্ডের সিবিআই তদন্তে যিনি অন্যতম অভিযুক্ত ৷ শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেও নাকি তাঁর সম্পর্ক বেশ ভালো ৷ উল্টোদিকে রাজু হোটেল ব্যবসা শুরু করেছিলেন ৷ বিজেপিতে যোগ দিয়ে 2021 সালে নির্বাচনের প্রচারে নেমে রাজনীতিতে হাত পাকানোর চেষ্টা করেছিলেন ৷ বিজেপির হারের পর এবং পুলিশ ও সিআইডি-র হাতে একাধিকবার গ্রেফতার হওয়ার পর গত দু’বছরে প্রচারের আলো থেকে সরে গিয়েছিলেন ৷
এমন একটি লোককে মেরে কার কী লাভ ? শিল্পাঞ্চলে কানপাতলে শোনা যাচ্ছে যে কাহিনিতে একটা টুইস্ট রয়েছে এখানেই ৷ সিবিআই তদন্তের জেরে লালা কোণঠাসা ৷ এই পরিস্থিতিতে আবার কয়লাপাচারে নিজের পুরনো জায়গা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন রাজু ৷ বিশেষ করে এই অঞ্চলের অনেক দরিদ্র মানুষ পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য বাধ্য হয়ে এই পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে যান ৷ তাই পঞ্চায়েতের আগে পাচারে গতি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে অনেকের মত ৷ এই সময়েই রাজু কি প্রত্যাবর্তন করতে চাইছিলেন ? সেক্ষেত্রে তিনি কি পুরনো সঙ্গীদের উপেক্ষা করছিলেন ? তাই কি তাঁকে এভাবে খুন করা হল ?
প্রশ্ন অনেক ৷ উত্তরও আপাতত অধরা৷ ঘটনার দিন সন্ধ্যায় রাজুর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সঙ্গী ব্রতীন মুখোপাধ্যায় ৷ তাঁকে ও গাড়ির চালককে জেরা করা হচ্ছে ৷ একটি ভাইরাল ভিডিয়োতে ঘটনাস্থলে আব্দুল লতিফকে দেখা গিয়েছে ৷ যিনি আবার গরুপাচার কাণ্ডে সিবিআইয়ের নজরে রয়েছে ৷ রাজুকে যে গাড়িতে মারা হয়, সেই গাড়িটিও লতিফের ছিল বলে জানা গিয়েছে ৷
ফলে রাজুকে দুর্গাপুরে না খুন করে, কেন শক্তিগড়ে নিয়ে গিয়ে এই হত্য়াকাণ্ড ঘটানো হল, সেই নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে ৷ আপাততত তদন্তকারীরা সেই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন ৷ তাঁদের আশা, শীঘ্রই এই তদন্তে সাফল্য আসবে ৷
আরও পড়ুন : রাজু ঝায়ের সঙ্গে বিজেপির কোনও সম্পর্ক ছিল না, বললেন দলের বিধায়ক; পালটা দাবি বাবুলের