একদিকে আমবন ৷ অন্যদিকে দিগন্ত অবধি টানা ধানখেত। ধান পেকে নুয়ে পড়েছে জমিতে। মাঝখান দিয়ে গেছে চওড়া রাস্তা। প্রায় সন্ধেবেলার রাস্তা খাঁ খাঁ নির্জন। এদিকে লোকবসতি কম। দূরে দূরে এক আধটা কাঁচা বাড়ি। এই তো সঠিক সময় ৷ দিনশেষে এপথেই ঘোড়ার গাড়িতে সাব পোস্ট অফিসের টাকা যায় কৃষ্ণনগর হেড পোস্ট অফিসে। রেইকি করে আগেভাগে ছকা প্ল্যান। কিন্তু গাাড়ি আসতে দেরি হচ্ছে ! আপাত নিরীহ আমবনের এক মোটা বেড়ের গাছের আড়ালে কে ?
ওত পেতে তরুণ বিপ্লবী অনন্তহরি মিত্র ৷ থেকে থেকে ঘড়ি দেখছেন। খানিক দূরে আরেক গাছের আড়ালে সমবয়সি তারাদাস মুখোপাধ্যায়। উত্তেজনায় ফুটছেন। সহকারী আরও কয়েকজন রয়েছেন এই অ্যাকশনে৷ তাঁদের একজন চড়ে বসেছেন এক গাছের মগডালে৷ গাড়ি আসছে দেখলেই আগাভাগে পাখির ডাকের ইশারা! এমনিতে ভুল হওয়ার কথা না। ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হয়েছে যত্নে। বিপ্লবের কাজে অর্থের জোগান দরকার। সেই মতো ডাকাতির ছক। গরিবকে লুট করা নয়, বরং এক ঢিলে দুইপাখি। শাসনের নাম শোষণ চালানো ইংরেজ সরকারের টাকা লুট করে একদিকে যেমন তাদের খানিক ক্ষতির মুখে ফেলা যাবে, তেমনই সেই টাকা কাজে লাগবে স্বদেশির কাজে। তবে ঝুঁকির কাজ৷ আগেই বলে দিয়েছিল রেড পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব। ধরা পড়লেই যবাজ্জীবন, ফাঁসিও হতে পারে। উত্তরে দেশমাতৃকার সেবায় জীবন উৎসর্গ করা অনন্তহরি, তারাদাসরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা মরলে যদি দেশ বাঁচে, তবে তাই হোক৷ আজ সেই "শুভদিন"৷ দেশের কাজে জান লড়িয়ে দিতে তৈরি ওঁরা৷
হঠাৎই শোনা গেল "পাখির ডাক"! একটু পরেই শোনা গেল জোড়া ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। গাড়ি কাছাকাছি আসতেই অনন্তহরির নির্দেশে হাঁক পাড়লেন তারাদাস৷ গাড়োয়ানকে গাড়ি থামাতে বললেন৷ জানিয়ে দিলেন, না থামালে বিপদ! এইসঙ্গে গুটি গুটি পায়ে জঙ্গল ছেড়ে রাস্তার দিকে এগোলেন বিপ্লবীরা৷ গাড়োয়ান পাত্তা দিল না হুঁশিয়ারি৷ গাড়ি থামল না৷ আরও একবার সতর্ক করা হল দেশি গাড়ায়ানকে৷ তাতে আরও জোরে ঘোড়া ছোটাল সে৷ কিন্তু, এ গাড়িকে থামাতেই হবে৷ সিন্দুক চাই৷ তবে, গরিব দেশওয়ালি গাড়োয়ানকে নিহত বা আহত করার ইচ্ছে নেই বিপ্লবীদের৷ তথাপি বাধ্য হয়ে তারাদাস গুলি ছুঁড়লেন গাড়োয়ানের পা লক্ষ্য করে৷ গুলির শব্দে শূন্যে ক্ষুর তুলে চিঁহি চেঁচাল দুটো ঘোড়া৷ যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে গাড়ি থামাল গাড়োয়ান৷ অনন্তহরি, তারাদাস আর বাকিরা মুহূর্তে ছুটে এলে রাস্তায়৷ দ্রুত কাজ সারলেন ওঁরা৷ ধরাধরি করে গাড়ি থেকে লোহার সিন্দুক নামিয়ে জোনাকি ওড়া অন্ধকার আমবনে চম্পট৷
অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ায় বাহবা দিয়েছিল নেতৃত্ব৷ তবে, বছর আঠারোর অনন্তহরির নেতৃত্বে প্রথম কাজ সফল হলেও গোল বেধেছিল৷ গোল বাধিয়েছিল ওই আমবনে সেই সময় ঘাপটি মেরে থাকা বসন্ত চৌধুরি নামে এক ব্যক্তি৷ ডাকাতির গোটা ঘটনা তার চোখের সামনেই ঘটে৷ সে ভেবেছিল বড় ডাকাতদলের কাজ৷ বিপ্লবীরা আমবনে সেঁধিয়ে গেলে সে-ই আগ বাড়িয়ে আহত গাড়োয়ানকে সঙ্গে করে নিয়ে থানায় খবর দেয়৷ যদিও তদন্তে নেমে পুলিশ বুঝে যায়, এ সাধারণ ডাকাতি না৷ কয়েকদিনের মধ্যেই কৃষ্ণনগর IB জেনে যায় বিপ্লবীদের নাম৷ খোঁজ শুরু হয় অনন্তহরির৷ যে ঘটনা বড়সড় বদল আনে অগ্নিযুগের অন্যতম বিপ্লবী অনন্তহরি মিত্রর জীবনে৷ এরপরই একদিন রাতের অন্ধকারে কৃষ্ণনগর ত্যাগ৷ পালিয়ে উত্তর কলকাতায় গা ঢাকা দেওয়া৷ জড়িয়ে পড়া বউবাজার বোমা মামলায়৷ যাতে যাবজ্জীবন করাদণ্ড হবে তাঁর৷ জেলে বন্দি হয়েও থামেনি কাজ৷ লক আপে লালমুখো সাহেবদের ধামা ধরা পুলিশ বিভাগের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট ভূপেন চট্টোপাধ্যায়ের ভবলীলা সাঙ্গ হবে! অনন্তহরি ও আরও কয়েকজনের হাতেই৷ সেই হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি৷ কতই বা বয়স তখন! মেরেকেটে কুড়ি৷
1906 সালে জন্ম অনন্তহরি মিত্রর৷ 1311 বঙ্গাব্দের 24 পৌষ ৷ বাবার নাম রামলাল মিত্র৷ বর্তমান বাংলাদেশের চুয়াডাঙা জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর নদিয়া) বেগমপুরে মামাবাড়িতে জন্ম ৷ কার্যত বালকবেলাতেই বিপ্লবী সঙ্গের শুরু৷ 15 বছর বয়সে 1921-এ অসহযোগ অন্দোলনে যোগ দেন৷ পরে গান্ধিবাদী পথ ছেড়ে রেড পার্টির সদস্য৷ এর কয়েক বছর পর ডাক বিভাগের গাড়িতে ডাকাতির ঘটনা৷ যার সাফল্যে পুলিশের খাতায় খতরনাক বিপ্লবী হিসেবে উঠে এল নাম৷ অতঃপর কলকাতায় অনন্তহরি৷
আগেই বলা হয়েছে, গা ঢাকা দিতে এসেই বিপ্লবের নয়া কাজ জড়িয়ে পড়েন অনন্তহরি মিত্র৷ সে আঠারোশো শতকের তৃতীয় দশকের কথা৷ তখনও অবধি বোমা তৈরির কৌশল জানে না ভূভারতের বিপ্লবীরা৷ কলকতায় রেড পার্টি সেই কাজই শুরু করেছে তলেতলে৷ সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, স্বদেশি মনোভাবাপন্ন বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ কেমিস্টদের৷ যাঁদের অন্যতম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়৷ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাস্টারদা সূর্য সেন৷ এই কাজে উত্তর কলকাতার বেশ কয়েকটি বাড়ি রাতে জেগে ওঠে, দিনে ঘুমায়! অনন্তহরিও হাত পাকাচ্ছেন বোমা তৈরির কাজে৷ সফল হন অগ্নিযুগের বাঙালি বিপ্লবীরা৷ উচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশ মতো অস্ত্রের উপযুক্ত ব্যবহার হবে৷ কিন্তু, খেচরদের মাধ্যমে খবর যায় পুলিশের কানে৷ শুরু হয় তল্লাশি৷ এদিকে দক্ষিণেশ্বরের একটি বাড়িতে অনন্তহরি মিত্র ও আরও কয়েকজন এতদিনের পরিশ্রমের অস্ত্র পাহারার দায়িত্বে ৷ খবর ছিল, একাধিক বাড়িতে অস্ত্র মজুত করায় এবাড়ির খবর পায়নি পুলিশ৷ কিন্তু এক কাকভারে পুলিশের রেড৷ তল্লাশি চালিয়ে রিভলভার, বোমা ও বোমা তৈরির প্রচুর সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ৷ গ্রেপ্তার হন অনন্তহরি মিত্র৷ উল্লেখ্য, উত্তর কলকাতার আরও একটি বাড়িতে মজুত ছিল সদ্য তৈরি বোমা৷ দক্ষিণেশ্বরের বাড়িতে পুলিশি অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে সে বাড়িকে সতর্ক করেন বিপ্লবীরা৷ ততক্ষণে অবশ্য সেখানেও পৌঁছেছে পুলিশ৷ বোমা বাঁচানো যায়নি৷ তবে, কোনওরকমে ছাদ লাফিয়ে, ভয়ংকরভাবে আহত হয়েও পুলিশকে ফাঁকি দিতে সফল হন মাস্টারদা৷
বিখ্যাত বউবাজার বোমা মামলার বিচারেই অনন্তহরি দত্ত ও প্রমোদরঞ্জন চৌধুরির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়৷ আরেকটি মত বলছে, এই মামলাতে তাঁদের ফাঁসির সাজা হয়েছিল৷ সে যাই হোক, আসল কথা ঢেঁকি স্বর্গেও ধান ভানে আর বিপ্লবী আমৃত্যু বিপ্লব করে৷ তাই স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রামের শুরু কৃষ্ণনগরের সাব পোস্ট অফিসের সিন্দুক ডাকাতি দিয়ে, তা শেষ হবে ভূপেন চট্টোপাধ্যায় হত্যার মাধ্যমে৷
ভূপেন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেকালের ডাকসাইটে বাঙালি দারোগা৷ সাহেবদের অতি বিশ্বস্তজন৷ বিপ্লবীদের ভাষায় প্রভূর পা চাটা সারমেয়৷ পুলিশ বিভাগের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট ভূপেনের অন্যতম কাজ ছিল আলিপুর জেলের রাজবন্দিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিনয় করা ও তাঁদের কাছ থেকে "হাঁড়ির খবর" বার করা৷ যাতে করে অ্যাকশনের আগেই ভেস্তে যায় প্ল্যান৷ একজন ভারতীয় তথা বাঙালি হওয়ার সুযোগ নিতেন ভূপেন৷ বন্দীদের সহানুভূতি দেখাতেন, দুর্বলতার সুযোগ নিতেন৷ তবে, ততদিনে ভূপেনের ছক জানা হয়ে গেছে রেড পার্টি নেতৃত্বের৷ অতএব, ভূপেনকে নিকেশ না করলেই নয়৷ গোপন নির্দেশ এল জেলবন্দি অনন্তহরি ও প্রমোদরঞ্জনের কাছে৷
1926 সালের 28 মে৷ জেলে সবে সকালের খাবারের পর্ব মিটেছে৷ অনন্তহরি, প্রমোদরঞ্জন সহ আরও কয়েকজনের লকআপে ঢোকেন ভূপেন চট্টোপাধ্যায়৷ চেনা কায়দায় আলাপ জমান৷ দু'চার কথা হতে না হতেই নিঃশব্দে ভূপেনকে ঘিরে ফেলে বিপ্লবীরা৷ আগে থেকে মজুত লোহার ডান্ডা দিয়ে ভূপেন চট্টোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেন অনন্তহরি ও প্রমোদরঞ্জন৷ পাহারদাররা ঘটনা আন্দাজ করে ছুটে আসার আগেই কাজ শেষ!
ভূপেন চট্টোপাধ্যায় হত্যা মামলার শুনানি অতি দ্রুত হয়৷ বিচারক ফাঁসির আদেশ দেন অনন্তহরি মিত্র ও প্রমোদরঞ্জন চৌধুরিকে৷ হত্যায় সহযোগিতা করায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় ধ্রুবেশ চট্টোপাধ্যায়, অনন্ত চক্রবর্তী ও রাধিকার৷ চার মাস পর৷ 1926 সালের 28 সেপ্টেম্বর ভোর৷ আকাশ যখন সিঁদুরে লাল তখন ফাঁসি হয় বছর কুড়ির অনন্তহরি মিত্রের৷ সূর্যোদয়েই সূর্যাস্ত! এমন হাজারো সূর্যাস্তেই তো সূর্যোদয় ঘোষিত হয়েছিল 15 অগাস্ট, 1947-এ৷
ভূপেন চট্টোপাধ্যায়ের দুঃসাহসিক হত্যার ঘটনা বিরাট প্রভাব ফেলেছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে৷ একদিকে যেমন আতঙ্কিত হয় শাসক৷ অন্যদিকে, কাগজে কাগজে খবর৷ অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের অন্যতম অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন চুয়াডাঙার অনন্তহরি মিত্র৷