মুর্শিদাবাদ, 10 অক্টোবর : ফেনসিডিল দিয়ে হাতেখড়ি । এরপর ঝোঁক বাড়ে হেরোইনে । তারপর সরাসরি গোরু পাচার । ইন্দো-বাংলা আন্তর্জাতিক সীমান্তে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে মহম্মদ এনামুল হক ওরফে এনামুল । সম্প্রতি আল কায়দা জঙ্গি যোগ মুর্শিদাবাদকে শিরোনামে এনেছে । কিন্তু তার অনেক আগেই মুর্শিদাবাদ বারবার শিরোনামে এসেছে এই এনামুলের হাত ধরে । 2018 সালে প্রথম CBI-এর জালে ধরা পড়ে । কিন্তু এখন সে কোথায় কেউ জানে না । তার নাগাল পেতে নাকানি চোবানি খাচ্ছেন CBI-র অনেক দুঁদে অফিসার । তবে অন্তরালে থেকেই আন্তর্জাতিক সীমান্তে গোরু পাচারচক্র সক্রিয় রেখেছে সে । এলাকার স্বঘোষিত 'ডন' এনামুল । এদিকে গোরু পাচারের টাকা কোথায় কোথায় যায় ? সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকেও টেনে এনেছেন অধীর চৌধুরি ।
খুব সময়ের সফরে এনামুল হক হয়ে উঠেছিল গোরু পাচারের বেতাজ বাদশা । এক ডাকে জেলা, রাজ্য তথা দিল্লি পর্যন্ত এনামুলকে চিনত । এই পাচারচক্রে ভর দিয়েই এখন এনামুল কয়েকটি সংস্থার মালিক । কয়েক হাজার কোটি টাকার মসনদে বসেই ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তে রাজ করছে সে । তবে CBI-র আতশ কাচের তলায় এসে এখন গা ঢাকা দিয়েছে । তবে সাম্রাজের পতন হয়নি । CBI আধিকারিকরা তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালাচ্ছেন । তল্লাশি হয়েছে তার বেশ কয়েকটি বাড়ি সহ কারখানাতেও ।
ছোটো থেকে পড়াশোনায় ঝোঁক ছিল না এনামুলের । উপার্জনের নেশা তার উপর চেপে বসে । উচ্চাকাঙ্খাই তাকে পাচারচক্রে টেনে এনেছিল । লালগোলা সীমান্তবর্তী এলাকায় বড় হয়ে ওঠা । তাই ছোটো থেকেই পাচারের খুঁটিনাটি রপ্ত ছিল । ফেনসিডিল থেকে হাত গুটিয়ে অল্প বয়স থেকেই হেরোইন পাচার শুরু করে । হেরোইন পাচারে ধরপাকড় শুরু হতেই এনামুল ঝুঁকে যায় গোরু পাচারে । সঙ্গে ছিল দুই ভাগ্নে । তাদের অন্যতম হল হুমায়ুন কবীর ওরফে পিন্টু ।
বিভিন্ন হাট থেকে গোরু কেনার পাশাপাশি কাস্টমস থেকে বেনামে নিলামে গোরু কিনত এনামুল । এনামুলের সঙ্গে যোগ ছিল BSF আধিকারিকের । সূত্রের খবর, 2015 থেকে 2018 সাল পর্যন্ত কার্যত বিনা বাধায় কয়েক লাখ গবাদি পশুকে সীমান্ত পার করিয়েছে তার সিন্ডিকেট । এরপরই CBI-র জালে ধরা পড়ে এনামুল । উঠে আসে BSF আধিকারিকের নামও । 2018 সালের মার্চে প্রথমবার CBI-র জালে ধরা পড়ে । যদিও সে বছরই জামিনে মুক্তি পায় । তবে জেরায় উঠে আসে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম । একইসঙ্গে BSF আধিকারিক জিবু ম্যাথিউয়ের নামও জানায় সে । যদিও সে বছরই ম্যাথিউকে গ্রেপ্তার করে CBI । 2018-র জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার হয় সে । তাকে 45.3 লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ছিল এনামুলের বিরুদ্ধে । ম্যাথিউয়ের থেকে 45.3 লাখ টাকা উদ্ধার করে CBI । BSF-এর 83 নম্বর ব্যাটেলিয়নে মুর্শিদাবাদে সীমান্তে কর্মরত ছিল সে ।
এরপর 2018-তেই সতীশ কুমার BSF-এর 36 নম্বর ব্যাটেলিয়নে কম্যান্ডান্ট পদে যোগ দেয় । এরপর থেকেই এনামুলের সাম্রাজ্য ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে । অভিযোগ, সতীশ কুমারের হাত ছিল তার উপর । বাছুরের দামে গোরু কিনে পাচার শুরু করে এনামুল । এপারে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি ছিল এনামুলের হাতে । সীমান্তের ওপারে ভাগ্নে হুমায়ুন কবীর কারবার চালাত । প্রথম দিকে নগদে লেনদেন । পরে লেনদেন হয় সীমান্তের হুন্ডি কারবারে । আরও পরে গোরুর বিনিময়ে ভারত সীমান্তে আসতে শুরু করে জালনোট, আগ্নেয়াস্ত্র । ধীরে ধীরে মাদক, গোরু পাচারে বেতাজ বাদশা হয়ে ওঠে পাড়াগাঁয়ের এনামুল । এমনকী সতীশ কুমারের ছেলে ভুবন ভাস্কর এনামুলের হক ইন্ডাস্ট্রিজ়ে চাকরি করত । CBI স্ক্যানারে সতীশের সঙ্গে রয়েছে ভুবনের নামও । পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলে এনামুলের গতিবিধি হয়ে উঠেছিল অবাধ । কলকাতার প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার সঙ্গে তার যোগ ছিল । দিল্লির এক প্রভাবশালী নেতার ছেলের কাছেও সে যেত বলে CBI তদন্তে উঠে এসেছে । এখানেই শেষ নয় । গোরু পাচারের টাকায় এনামুল এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক । নামে-বেনামে রয়েছে দুটি রাইস মিল, রডের ফ্যাক্টরি, ইটভাটা, চাল, পিঁয়াজ রপ্তানির কারবার ।
তবে সম্প্রতি মামার সঙ্গে কারবারে টক্কর শুরু হয় ভাগ্নে পিন্টুর । নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি করে আলাদা ব্যবসা করতে গিয়েই মামার সঙ্গে বনিবনা তলানিতে ঠেকে । কয়েকদিন দুবাইয়ে গা ঢাকা দেয় পিন্টু । এখন বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে গোরু পাচারের নিজের আলাদা কারবার চালাচ্ছে ।
মূলত টাকার নোটের উপর লেখা সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে গোরু পাচার চলে । ওই টাকাতেই সাংকেতিক হরফে লেখা থাকে কতগুলি গোরু যাচ্ছে । থানা বা সীমান্তরক্ষীদের চেক পোস্টে ওই টাকা দেখালেই অবাধ গতিবিধির ছাড়পত্র মেলে । গোরু পাচারের টাকা কোথায় কোথায় যায় তা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা । প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকেও টেনেছেন এই ঘটনায় । অধীরবাবু বলেন, গোরু পাচারের এই চক্রের কথা সবাই জানে । কিন্তু প্রশ্ন এই অবাধ পাচার দীর্ঘদিন ধরে চলে কীভাবে । রাজনৈতিক মদত ছাড়া কি এ সম্ভব ? BSF আধিকারিকরা যে এর সঙ্গে জড়িত তার প্রমাণ আগেও পাওয়া গিয়েছে । এরপর সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি । বলেন, "আপনি বলুন দিদি, এই টাকা কোথায় কোথায় যায় ? আপনার কাছে যায় না ?"
তবে কংগ্রেসের এই অভিযোগ একেবারেই মেনে নিতে রাজি নয় জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব । জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সহ সভাপতি অশোক দাস বলেন, "এনামুল যে গোরু পাচার চক্র চালায় তা সবাই জানে । তবে কংগ্রেসের অভিযোগ ভুল । পাচারের টাকা অনেক BJP নেতার কাছে যায় । "
এদিকে BJP-র অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকেই । জেলা BJP-র সাধারণ সম্পাদক তপন চন্দ্রের অভিযোগ, এই পাচারের সঙ্গে জড়িত অনেক তৃণমূল নেতাই । পাচারের টাকার অংশ অনেক তৃণমূল নেতার কাছেই যায় ।
রাজনৈতিক শিবির একে অপরের দিকে আঙুল তুলছে ঠিকই । কিন্তু CBI তদন্তের তথ্য এবং স্থানীয়দের বয়ান মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় রাজনৈতিক মহলের অনেক প্রভাবশালীর হাতই এনামুলের মাথার উপর ছিল বা আছে । তবে স্বঘোষিত ডন এনামুল এইভাবে পাচার চক্র বহাল রাখার বিরুদ্ধে কী ভাবেন স্থানীয়রা ? তাঁরা কার্যত এনামুলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেই চান না । কারণ আশপাশের গ্রামের অনেক মানুষকেই আর্থিক সাহায্য করেছে এনামুল । লালগোলা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আন্তর্জাতিক স্তর- অপরাধ দুনিয়ায় অন্যতম নাম মহম্মদ এনামুল হক ।