মালদা, 26 মে: রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ঈশ্বরী, অন্নপূর্ণার কাছে সন্তানদের দুধে-ভাতে থাকার বর চেয়েছিলেন ৷ তাঁর ইচ্ছেপূরণ হয়েছিল কি না জানা নেই ৷ তবে বর্তমানের ঈশ্বরী দুধ পেলেও ভাত পায়নি ৷ সেই ভাতের সংস্থানের জন্য সবার কাছে আর্জি জানাচ্ছে সে ৷
পুরাতন মালদা পৌরসভার 15 নম্বর ওয়ার্ডের ঘোষপাড়ার বাসিন্দা ঈশ্বরী ৷ বাবা ব্রজদুলাল সাঁপুই মারা গিয়েছেন 10 বছর আগে ৷ মা স্থানীয় একটি স্কুলে মিড ডে মিলের রাঁধুনি ৷ একটিই বোন তার ৷ ক্লাস এইটে পড়ে ৷ এই ঈশ্বরীই এ বার উচ্চমাধ্যমিকে কলাবিভাগে 471 নম্বর পেয়েছে ৷ 94.2 শতাংশ নম্বর পেয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তার চিন্তা আরও বেড়েছে ৷ শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে এতটা দূর এগোতে পারলেও তার ভবিষ্যৎ কী ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই সে দিশেহারা ৷
কথায় বলে, দুধে নাকি মেধা বাড়ায় ৷ বর্তমানের ঈশ্বরীর সেই মেধা ছোট থেকেই ৷ কিন্তু মাসিক গড়ে তিন হাজারি সংসারে পেট ভরা ভাতের সংস্থান হয় না ৷ সেখানে উচ্চশিক্ষা দূরের কথা, পড়াশোনার কথা ভাবাটাও ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আকাশকুসুম কল্পনা ! কিন্তু সেই ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে, ঘরের মাথায় টিনের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতেই স্বপ্ন দেখেছে সে ৷ নিজেকে গড়ার লড়াইয়ে নেমে পড়েছে দিনরাত ৷ পাশে পেয়েছে শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে বন্ধুদেরও ৷ এভাবেই লড়াই চলবে ৷ দৃপ্তকণ্ঠে তার বার্তা ৷ তবে কেউ তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে লড়াইটা লড়তে তার সুবিধে হয় ৷
জন্ম থেকেই হাতের আঙুলে সমস্যা ঈশ্বরীর ৷ একই সমস্যা তার বোন সিদ্ধেশ্বরীরও ৷ চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছেন, জিনঘটিত সমস্যা ৷ 85 শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সরকারি শংসাপত্র রয়েছে তার ৷ প্রতি মাসে সরকারের তরফে এক হাজার টাকা ভাতাও জোটে ৷ কিন্তু অভাব কাটে না ৷
ঈশ্বরী জানাচ্ছে, “আমি শুধু চেষ্টা করে গিয়েছি ৷ তবে এতটা ভালো ফল হবে আশা করিনি ৷ শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে বন্ধু, সবাইকে সবসময় পাশে পেয়েছি ৷ আমার বাবা আবৃত্তি আর আঁকা শেখাতেন ৷ 2013 সালে মারা যান ৷ তাঁর মৃত্যুর পর আমরা চোখে আঁধার দেখি ৷ আমার মা তেমন কিছু করতে পারতেন না ৷ বেঁচে থাকার তাগিদে মা একটি স্কুলে মিড ডে মিলের রাঁধুনি হিসাবে যোগদান করেন ৷ মাসে দেড় হাজার টাকা পান ৷ যেহেতু তিনি সেলাই জানেন, তাই বাড়িতে অল্পবিস্তর সেই কাজ করেন ৷ এতেই সংসার চলে ৷ এত অভাবে অনেক আগেই আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ৷ কিন্তু তখনই আমার পাশে দাঁড়ান আবৃত্তির দিদিভাই, মালদা রেলওয়ে হাইস্কুলের শিক্ষিকা রেশমি সেনগুপ্ত ৷ তিনি আজ আমার শুধু শিক্ষিকা নন, আমি তাঁর পরিবারের অংশ ৷"
ঈশ্বরী জানিয়েছে, অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাকে সবসময় সাহায্য করেছেন ৷ স্কুলও সবসময় তার পাশে থেকেছে ৷ স্কুলে তাকে কোনও বেতন দিতে হত না ৷ সংসার চালাতে মাকে কিছুটা সাহায্য করতে সে বছর দুয়েক ধরে মাটির গয়না, রাখি, শো-পিস, এ সব তৈরি করছে ৷ শিক্ষিকাদের সঙ্গে বন্ধুরাও সে সব কিনে তাকে সাহায্য করে ৷
ঈশ্বরীর কথায়, "আমি ভালো মানুষ হয়ে এই সাহায্যের প্রতিদান দিতে চাই ৷ ভবিষ্যতে স্কুল অথবা কলেজে বাংলা বিষয়ে শিক্ষকতা করা আমার লক্ষ্য ৷ যাদবপুর কিংবা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাই ৷ কিন্তু আমার স্বপ্ন পূরণ করার সামর্থ মায়ের নেই ৷ তাই যদি কোথাও থেকে কোনও সাহায্য পাই, কৃতজ্ঞ থাকব ৷ আমার ফোন নম্বর 6295396892৷”
ঈশ্বরীর মা বুলটিদেবী জানান, “মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হতে চায় ৷ কিন্তু আমি পেরে উঠছি না ৷ সবার সাহায্যে মেয়ে এতদূর এসেছে ৷ যদি কেউ সাহায্য করে, মেয়েটা আরও সামনের দিকে এগোতে পারবে ৷ মেয়ের আবৃত্তির দিদিভাই, রেশমিদি আমাদের চিন্তা করতে বারণ করেছেন ৷ কিন্তু তিনিই বা কত সাহায্য করবেন ! শিক্ষিকারা তো দীর্ঘদিন ধরেই মেয়ের পাশে রয়েছেন ! আর কত করবেন ! তাই যদি কেউ মেয়েটাকে সাহায্য করেন, খুব ভালো হয় ৷ পরিস্থিতির শিকার হয়ে মা হয়েও কখনও কখনও মেয়েকে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বলি ৷ দুই মেয়েকে ঠিকমতো খাবারও দিতে পারি না ৷ আমি অল্পশিক্ষিত ৷ তাই প্রশাসনের কাছে সহায়তার আবেদন জানানোর সাহস পাইনি ৷”
মালদা শহরের বার্লো গার্লস হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে ঈশ্বরী ৷ ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দীপশ্রী মজুমদারকে তার বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি বলে ওঠেন, ঈশ্বরী যদি বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায়, তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য জেলা প্রশাসনেরও তাকে সাহায্য করা উচিত ৷ বাকি সাহায্যের জন্য তারা তৈরি আছেন বলে জানান তিনি ৷ ওই স্কুলে সাপোর্ট বার্লো নামে একটি ফান্ড রয়েছে ৷ স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে শিক্ষাকর্মীরা সবাই প্রতি মাসে সামর্থমতো টাকা দিয়ে সেই ফান্ড তৈরি করেন ৷ ওই ফান্ড থেকে ঈশ্বরীকে সবরকম সাহায্য করতে স্কুল প্রস্তুত বলে জানান প্রধান শিক্ষিকা ৷ তাঁর কথায়, "ও খুব ভালো মেয়ে ৷ পড়াশোনার সঙ্গে ওর আবৃত্তি, ছবি আঁকা, নাচ, হাতের কাজ তারিফযোগ্য ৷ ও স্কুল অন্তঃপ্রাণ ৷ তাই ওকেও সবাই খুব ভালোবাসে ৷ জীবন গড়ার লড়াইয়ে প্রতিক্ষণে আমরা ওর পাশে রয়েছি ৷”
আরও পড়ুন: জয়েন্টে চতুর্থ মেদিনীপুরের সৌহার্দ্যর তিন নম্বরের জন্য স্থান হয়নি উচ্চমাধ্যমিকের মেধাতালিকায়