মালদা, 5 সেপ্টেম্বর: আরও একবার ইতিহাসের সোনালি দিনে ফিরে যাওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করল মালদার রেশম শিল্প ৷ কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে প্রায় 4 কোটি টাকা ব্যয়ে মালদার শেরশাহিতে বসেছে 10টি অত্যাধুনিক মাল্টি এন্ড রিলিং মেশিন ৷ নতুন আসা এই মেশিনগুলির ট্রায়াল রান শুরু হয়েছে ৷ এই যন্ত্রের সাহায্যে এবার উন্নত মানের রেশম সুতো জেলাতেই তৈরি হবে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের ৷ ফলে বাড়বে রেশম চাষ ও সুতো উৎপাদন ৷ জেলার রেশম সুতোর বহির্বাণিজ্যের সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যাবে ৷ সবচেয়ে বড় বিষয়, এর ফলে জেলায় বড় ধরনের রেশমি কাপড়ের শিল্প তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে রাজ্যের রেশম দফতর ৷ তাতে যেমন অনুসারী শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা বাড়বে, তেমনই কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে ৷
মালদা জেলার রেশম ইতিহাস অতি প্রাচীন ৷ মুঘল আমলেও এখানে রেশম চাষ প্রচলিত ছিল বলে কথিত আছে ৷ সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে ৷ আবহাওয়া যেমন প্রতিকূল হতে থাকে তেমনই কমতে থাকে সরকারি সুযোগ সুবিধেও ৷ পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্যও জেলায় উৎপাদিত রেশম সুতোর বাজার পড়তে শুরু করে ৷ বহু রেশমচাষি পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন ৷ যদিও, সাম্প্রতিক সময়ে সরকার এদিকে বিশেষ নজর দেওয়ায় পরিস্থিতির বদল ঘটেছে ৷
এই মুহূর্তে মালদায় প্রায় 21 হাজার একর জমিতে তুঁত চাষ করা হচ্ছে ৷ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত 5 লাখের বেশি মানুষ ৷ প্রায় 61 হাজার পরিবারের সংসার চলে এই শিল্পের মাধ্যমে ৷ জেলার প্রায় সব ব্লকে রেশমের চাষ হলেও সবচেয়ে বেশি রেশম উৎপাদন হয় কালিয়াচকের তিনটি ব্লকে ৷ জেলায় প্রতি বছর গড়ে 1500 মেট্রিক টন কোকুন উৎপন্ন হয় ৷ এর মধ্যে রয়েছে তিন প্রজাতির রেশম ৷ নিস্তারি অর্থাৎ, পুরনো দিনের হলুদ রংয়ের সুতো ৷ উন্নত মানের বাইভোল্টাইন অর্থাৎ, সাদা রংয়ের সুতো এবং দুই প্রজাতির মিশ্রনে এফ-1 নামে আরেক প্রজাতির কোকুনও উৎপাদন করা হচ্ছে ৷ এই সুতোর রং হালকা ঘিয়ে ৷ বাইভোল্টাইন সুতোর দামই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ৷ এর প্রতি কিলোর দাম গড়ে 5 হাজার টাকা কিংবা তার বেশি ৷
আরও পড়ুন: রেশম শিল্পের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও মিলছে না সঠিক মজুরি, অনিশ্চিয়তায় ধুঁকছেন শিল্পীরা
মালদায় এতদিন হাত রিলিং মেশিনে কোকুন থেকে রেশম সুতো তৈরি করা হত ৷ এতে সুতোর গুণমান খুব একটা ভালো হত না ৷ সুতো অনেক মোটা হত ৷ ফলে সেই সুতো চিন বা জাপানের সুতোর সঙ্গে বাজারে পাল্লা দিতে পারত না ৷ এমনকী বেঙ্গালুরুতে তৈরি সুতো মালদার তুলনায় অনেক ভালো ৷ কিন্তু, এবার মাল্টি এন্ড রিলিং মেশিনে তৈরি সুতো চিন-জাপানের সুতোর মতো সূক্ষ্ম ও মসৃণ হবে ৷ প্রতিটি মেশিনে থাকা 10টি এন্ডের প্রতিটিতে 10টি পয়েন্টে সুতো তৈরি হবে ৷ অর্থাৎ 10টি মেশিনে 100টি পয়েন্ট থেকে সুতো বের করা যাবে ৷ রেশম দফতরের তরফে কালিয়াচক 1 নম্বর ব্লকের শেরশাহি এলাকায় 10টি মাল্টি এন্ড রিলিং মেশিন বসানো হয়েছে ৷
আরও পড়ুন: রাজ্য থেকে সেরা রেশম সুতো উৎপাদক কালিয়াচকের আনসারুল শেখ
এ নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে রাজ্য রেশম দফতরের জয়েন্ট ডিরেক্টর (উত্তরবঙ্গ) অরূপ ঠাকুর ইটিভি ভারতকে জানান, রাজ্যের মোট রেশমের 70 শতাংশই উৎপাদিত হয় মালদায় ৷ সেখানে আপাতত 10টি মাল্টি এন্ড রিলিং মেশিন বসানো হয়েছে ৷ তবে, এর থেকেও উন্নত অটোমেটিক রিলিং মেশিন আছে ৷ কিন্তু, তাতে শুধুমাত্র বাইভোল্টাইন ছাড়া অন্য কোনও কোকুন ব্যবহার করা যাবে না ৷ উপরন্তু ওই মেশিন ব্যবহারে অনেক মানুষ কাজ হারাবেন ৷ আর বাইভোল্টাইন কোকুন তৈরির মতো আবহাওয়া এবং পরিকাঠামো রাজ্যে নেই ৷ মাল্টি এন্ড রিলিং মেশিন কীভাবে চালাতে হয় ? এর জন্য রাজ্য সরকারের তরফে দ্রুত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ৷ তবে, শুধু মালদা নয়, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম-সহ অন্যান্য জেলার কোকুনও মালদায় আসবে বলে জানিয়েছেন তিনি ৷
শেরশাহির রিলার মহম্মদ আনসারুল শেখ জানাচ্ছেন, "এই মেশিন আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ৷ শেষ পর্যন্ত সরকার আমাদের এখানে এই মেশিন পাঠিয়েছে ৷ এর জন্য মুখ্যমন্ত্রী এবং রেশম দফতরকে ধন্যবাদ ৷ এবার আমরা চিন-জাপান ও বেঙ্গালুরুর সুতোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব ৷ তবে, এই মেশিনে অনেক সুতো অপচয় হচ্ছে ৷ তার জন্য আমাদের সিড মেশিন প্রয়োজন ৷ রাজ্য সরকারের কাছে আমার আবেদন, ওই মেশিনটি আমাদের যেন অবশ্যই দেওয়া হয় ৷"
এতদিন জেলায় কাজের তেমন সুযোগ না থাকায় বেঙ্গালুরু কিংবা কাশ্মীরে কাজে যাচ্ছিলেন রেশম সুতো তৈরিতে দক্ষ শ্রমিকরা ৷ আশা করা হচ্ছে, এবার তাঁরা জেলায় কাজ পাবেন ৷ সে কথাই শোনালেন আসরাফুল মোমিন নামে এক শ্রমিক ৷ তিনি বলেন, "আমরা বাইরে কাজ করতে যেতাম ৷ কখনও কাশ্মীর, কখনও মহারাষ্ট্র ৷ এবার গ্রামেই এই মেশিন বসেছে ৷ আর আমাদের বাইরে কাজ করতে যেতে হবে না ৷"