মালদা, 3 জুলাই : চাপের মুখে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হল হবিবপুর ব্লকের বুলবুলচণ্ডী গিরিজাসুন্দরী বিদ্যামন্দির কর্তৃপক্ষ । ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা-আলাদা ক্লাস করানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এল স্কুল কর্তৃপক্ষ । জানিয়ে দিল, বৃহস্পতিবার থেকে ছাত্রী-ছাত্রীরা একসঙ্গেই ক্লাস করবে ।
স্কুলের ইলেভেন ও টুয়েলভের পড়ুয়ারা নিজেদের মধ্যে 'মন দেওয়া নেওয়া'-য় মেতে রয়েছে বলে অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি এক আজব সিদ্ধান্ত নেন গিরিজাসুন্দরী বিদ্যামন্দিরের শিক্ষকরা । তাঁরা ঠিক করেন, সপ্তাহে তিন দিন ছেলে ও তিনদিন মেয়েদের ক্লাস নেওয়া হবে । সোম, বুধ ও শুক্রবার ক্লাস করবে মেয়েরা । বাকি তিনদিন ক্লাস হবে ছেলেদের । এমন সিদ্ধান্তের কথা ছড়িয়ে পড়তেই ঝড় ওঠে জেলায় । স্কুল কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন জেলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শক তাপসকুমার বিশ্বাস । যদিও গতকাল স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ পান্ডে দাবি করেছিলেন, 'অভিযুক্ত' ছেলেমেয়েদের চিহ্নিত করতে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। সমস্যা মিটে গেলেই ফের পুরনো প্রথায় একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শুরু হবে ।
গিরিজাসুন্দরী বিদ্যামন্দিরটি পথ চলা শুরু করেছিল 1946 সালে । বর্তমানে স্কুলের পড়ুয়া সংখ্যা 1726 । শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন 38 জন। 1990 সালে স্কুলটি উচ্চ মাধ্যমিকস্তরে উন্নীত হয় । প্রথম থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত ছেলেরা পড়ে । ইলেভেন ও টুয়েলভের ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও পড়াশোনা করে । বর্তমানে স্কুলে ইলেভেনে মোট পড়ুয়া রয়েছেন 209 জন । তার মধ্যে 169 জন ছাত্র ও 60 জন ছাত্রী । টুয়েলভে মোট 226 জন পড়ুয়ার মধ্যে ছাত্রের সংখ্যা 183, ছাত্রী 43 জন। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, কয়েক বছর ধরেই নাকি ইলেভেন ও টুয়েলভে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়ার পালা চলছে । এ নিয়ে গত বছর স্কুলে বড়মাপের ঝামেলাও বাধে । শিক্ষকদের নিগ্রহ করা হয় বলেও অভিযোগ ।
এই সংক্রান্ত খবর : 'মন চুরি' রুখতে ছাত্র-ছাত্রীদের পৃথক দিনে ক্লাসের নিদান
আজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক জগদীশ সরকার বলেন, "সম্প্রতি স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রেমের বিষয়টি সামনে আসে । তারপরই সপ্তাহে তিনদিন ছেলেদের ও বাকি তিনদিন মেয়েদের ক্লাস নেওয়া সিদ্ধান্ত । পুরো সিদ্ধান্তটাই ছিল আমাদের নিজেদের । স্কুলে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ।" এ দিকে, এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন স্কুলের পরিচালন কমিটির সভাপতি প্রভাস চৌধুরি । তিনি আবার হবিবপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি। প্রভাসবাবু বলেন, "যে অভিযোগ উঠেছে তা সঠিক । স্কুলের পরিবেশ বজায় রাখতে হয়তো শিক্ষকরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । কিন্তু এটা আইনগত নয় । স্কুলেরও কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। সেটা কেউ এড়িয়ে যেতে পারেন না । আবার সামাজিকতা বলেও একটি জিনিস রয়েছে । শিক্ষকরা এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন । তাঁরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা কখনই সমর্থনযোগ্য নয় । নির্দেশ দিয়েছি দ্রুত পুরনো প্রথায় ক্লাস শুরু করার জন্য । ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না ।"
স্কুল কর্তৃপক্ষের এহেন সিদ্ধান্ত নিয়ে ভিন্ন মত ছাত্রীদের মধ্যেই । ইলেভেনের ছাত্রী পর্ণা সরকারের মতে, "ঘটনাটি ছোটো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে । একদিন একটি ছেলে একটি মেয়ের কাছ থেকে জল চায় । তার জন্য সেই মেয়েটির দাদা তাকে বকাবকি করে । খবর যায় শিক্ষকদের কানে । এরপরেই শিক্ষকরা ক্লাস নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নেন । আমরা শিক্ষকদের কাছে কোনও অভিযোগ জানাইনি । শিক্ষকরা নিজেরাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক সপ্তাহ ধরে এভাবেই ক্লাস চলছে। তবে ছেলেরা না থাকায় আমাদের ক্লাস করতে কিছুটা সুবিধা হচ্ছে । ছেলেরা থাকলে তাদের চেঁচামেচিতে আমরা শিক্ষকদের কথা শুনতে পেতাম না । এখন আমরা শিক্ষকদের প্রতিটি কথা শুনতে পাই।" অন্যদিকে, টুয়েলভের ছাত্রী মনীষা দাস বলেন, '' ছেলেরা সবসময় বিরক্ত করত। ক্লাসের ভিতরে তো বটেই, মেয়েদের কমনরুমের সামনেও তারা দাঁড়িয়ে থাকত । টিটকারি দিত । শিক্ষকরা ক্লাস নিয়ে নতুন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । এতে আমাদের উপকারই হয়েছে ।"
গিরিজাসুন্দরী বিদ্যামন্দিরের এই সিদ্ধান্তে সরব জেলার শিক্ষামহল । শিক্ষাবিদ সুস্মিতা সোম বলেন, "আমরা যে সময়ে বাস করছি, সেই সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে এমন বিভাজনের কথা কোথাও লেখা নেই । তা ছাড়া স্কুলটি তো কো-এড। ইলেভেন কিংবা টুয়েলভের ছাত্রছাত্রীরা নিশ্চিতভাবেই নিজেদের ভালোমন্দ কিছুটা বুঝতে শিখেছে । তারা যদি নিজেদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, সেটা তাদের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। "