মালদা, 15 নভেম্বর: নথি বলছে, জেলার আয়তন 3733 বর্গ কিলোমিটার ৷ মৌজার সংখ্যা 1814 ৷ বাস্তবে কিন্তু এই হিসাব মেলে না ৷ ক’দশক আগেও এই জেলায় ছিল 147টি গ্রাম পঞ্চায়েত ৷ তার মধ্যে একটি নিশ্চিহ্ন ৷ ছবি হওয়ার প্রহর গুনছে আরও গোটা চার-পাঁচেক ৷ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রলয় চালিয়ে যাচ্ছে গঙ্গা (River Erosion in Malda)৷ দোসর ফুলহার, মহানন্দা, এমনকী টাঙন-কালিন্দ্রীর মতো লো প্রোফাইলে থাকা নদীগুলিও ৷ দিনের পর দিন সংকুচিত হচ্ছে মালদা ৷ নদী ভাঙন নিয়ে চলছে রাজনীতির সঙ্গে পকেট ভরার প্রতিযোগিতা ৷ কিন্তু আর কতদিন ! মেরেকেটে 20 বছর ! তেমনটাই মনে করছেন ভাঙন নিয়ে ঘর করা গঙ্গাপাড়ের মানুষ (Malda News)৷
ঝাড়খণ্ডের রাজমহল দিয়ে মালদা জেলায় ঢুকেছে গঙ্গা ৷ ফরাক্কার কাছে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবেশ করেছে ৷ এরপর বাংলাদেশের দিকে তার প্রধান ধারা চলে গিয়েছে ৷ নিম্নগতির অববাহিকায় থাকার ফলে গঙ্গা প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে পলি বয়ে নিয়ে আসছে এই জেলায় ৷ রাজমহল পাহাড়ের নিচে থাকা পাথুরে খাতে সেই পলি সে ফেলে রাখতে পারছে না ৷ পলি বয়ে আসছে আরও নিচের দিকে ৷ ফরাক্কা ব্যারেজের জন্য সেই পলি আরও নিচের দিকে যেতে বাধা পাচ্ছে ৷ ফলে ওই পলি মূলত সঞ্চিত হচ্ছে নদীর মালদা-মুর্শিদাবাদ জেলার অংশে ৷ কিছু পলি ভাগীরথী হয়ে নেমে যাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের দিকে ৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সঞ্চিত পলিই কাল হয়েছে মালদা আর মুর্শিদাবাদ জেলার ৷ এর মধ্যে নদীর বড় বাঁকের জন্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মালদা ৷ রতুয়া 1, মানিকচক, কালিয়াচক 2 ও 3, এমনকী ইংরেজবাজার ব্লকের একাংশেও গঙ্গা পাড় কাটছে ৷ মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, ফরাক্কা, ধুলিয়াক ও জঙ্গিপুরও গঙ্গা ভাঙনে বিধ্বস্ত ৷ কিন্তু তুলনামূলক বেশি ক্ষতি হয়েছে মালদা জেলারই ৷ গত 50 বছরে গঙ্গা বদলে দিয়েছে এই জেলার আর্থ সামাজিক পরিকাঠামোও ৷
দিন যত গড়াচ্ছে, গঙ্গা ভাঙনের স্থায়িত্বও বেড়ে চলেছে প্রতি বছর ৷ এ বছর অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত দফায় দফায় পাড় কেটেছে নদী ৷ যা আগে কখনও হয়নি বলেই প্রশাসন সূত্রে খবর ৷ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভয়াল ভাঙনে একটি আস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ নদীগর্ভে মিলিয়ে গিয়েছে 67টি মৌজা ৷ 2003-04 সালে গঙ্গায় মিলিয়ে যায় কালিয়াচক 2 নম্বর ব্লকের কেবি ঝাউবোনা গ্রাম পঞ্চায়েত ৷ আরও কয়েকটি পঞ্চায়েত মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার পথে ৷ কিন্তু এখনও পর্যন্ত গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান কিংবা নমামি গঙ্গে প্রকল্পে এই জেলায় ভাঙন রোধের স্থায়ী কাজ শুরুই হয়নি ৷
ক’দিন আগেই মালদায় এসেছিলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী ৷ গঙ্গা ভাঙন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন, “গঙ্গা ভাঙন মালদা আর মুর্শিদাবাদ জেলার অভিশাপ ৷ বছরের পর বছর, গ্রামের পর গ্রাম গঙ্গায় তলিয়ে যাচ্ছে ৷ কিন্তু ভাঙন রোধের কাজ করা নিয়ে কেন্দ্র আর রাজ্য একে অন্যের কোর্টে বল ঠেলছে ৷ পার্লামেন্টে অনেকবার বিষয়টি উত্থাপন করেছি ৷ কিন্তু কারও কোনও হেলদোল নেই ৷ ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন গঙ্গা ভাঙনকে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল ৷ এ নিয়ে আইনও প্রণয়ন করা হয়েছিল ৷ ভাঙন বিধ্বস্ত জেলাগুলির জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজ্য সরকার কোনও আলোচনা করে না ৷ আমি আর দক্ষিণ মালদার সাংসদ ডালুবাবু ফের বিষয়টি সংসদে তুলব ৷ ইতিমধ্যে এ নিয়ে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছি ৷ ফোনও করেছি ৷”
আরও পড়ুন: কালিন্দ্রীর ভাঙনে বিপন্ন গ্রাম, আতঙ্কে তিনঘরিয়াবাসী
যে এলাকায় গঙ্গা ভাঙনে আস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত তলিয়ে গিয়েছে, সেই এলাকারই বিধায়ক সাবিনা ইয়াসমিন ৷ তিনি আবার সেচ দফতরের প্রতিমন্ত্রীও ৷ তাঁর বক্তব্য, “নদী ভাঙনের জন্য মালদার পরিস্থিতি খুব খারাপ ৷ কোনও কিছুই বাঁচানো যাচ্ছে না ৷ রাজ্য সরকারের তরফে আমরা ভাঙন রোধের চেষ্টা করছি ৷ কোথাও অস্থায়ীভাবে, কোথাও স্থায়ীভাবে ৷ কিন্তু যে হারে ভাঙন হচ্ছে, তাতে এই কাজ কিছুই নয় ৷ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করাটা বোধহয় অসম্ভব ৷ এই সমস্যার সমাধানে কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে ৷ 2005 সালে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন প্রণব মুখোপাধ্যায় গঙ্গা ভাঙনকে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা করেছিলেন ৷ তাই কেন্দ্রীয় সরকার এগিয়ে না এলে এই সমস্যায় পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয় ৷ এর জন্য প্রচুর টাকার দরকার ৷ এ বার আমরা মালদায় 100 কোটি আর মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জে 40 কোটি টাকার কাজ করেছি ৷ কিন্তু ভাঙন রোখা যায়নি ৷ আমরা বিহার সরকারের সঙ্গেও আলোচনা করছি ৷ কারণ, এই সমস্যা সমাধানে বিহারকেও এগিয়ে আসতে হবে ৷ আমরা নিজেদের রিপোর্ট পেশ করলেও বিহার সরকার তা পেশ করেনি ৷ আমরা নিজেদের এক্সপার্ট টিম বিভিন্ন ভাঙন প্রবণ এলাকায় পাঠাচ্ছি ৷ কেন্দ্র এই সমস্যা নিয়ে আমাদের কোনও সহায়তা করছে না ৷ এটা রাজনীতির বিষয় নয় ৷ আমরা কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম, সবাইকেই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে বলছি ৷ মানুষ বিপদে পড়লে রাজনীতি কাজে আসবে না ৷”
সাবিনা জানান, “যদি এভাবে কেন্দ্রীয় সরকার অসহযোগিতা করে তবে আমরা মানুষকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করব ৷ আজ বাজ পড়ে মারা গেলে দু’লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় ৷ তাহলে গঙ্গা ভাঙনে বিধ্বস্ত মানুষ কেন আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবে না ? বিষয়টি কিন্তু আমাদের ইস্যু হতে যাচ্ছে ৷ এই মানুষদের আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলনে নামব ৷ নদী ভাঙনে মালদার ভবিষ্যৎ খুব খারাপ ৷ এই জেলার আয়তন দিনের পর দিন কমছে ৷ কেবি ঝাউবোনা গ্রাম পঞ্চায়েত ইতিমধ্যে নিশ্চিহ্ন ৷ আরও কিছু পঞ্চায়েত ইতিহাস হওয়ার পথে ৷ নদীতে জেগে ওঠা চরের জমি বিধ্বস্ত মানুষদের দেওয়ার জন্য আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসব ৷ ওই চরগুলি বিহার-ঝাড়খণ্ড দখল করার চেষ্টা করছে ৷ ইতিমধ্যে হামিদপুর চর আমি এই রাজ্যের আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছি ৷ বাকিগুলিকেও পশ্চিমবঙ্গের অধীনে নিয়ে আসা হবে ৷”
গঙ্গা ভাঙন দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য দেবজ্যোতি সিনহা ৷ তিনি বলেন, “পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর ৷ ইতিমধ্যে মালদার 67টি মৌজা গঙ্গাগর্ভে চলে গিয়েছে ৷ এক লাখ একর জমি নদীগর্ভে ৷ সাড়ে সাত লাখ মানুষ ভাঙনে উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছে ৷ কেবি ঝাউবোনার পর বীরনগর 1 ও 2, মিলকি, খাসকোল, গোপালপুর-সহ ভূতনি, মহানন্দটোলা আর বিলাইমারি আর বছর তিনেকের মধ্যে গঙ্গায় চলে যাবে ৷ এই বিপর্যয়ের ভয়াবহতা কোনও সরকারই বুঝতে পারছে না ৷ একবার গঙ্গা-ফুলহার মিশে গেলে গোটা মালদা জেলাটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে ৷ ফরাক্কা ব্যারেজ শুকিয়ে যাবে ৷ কেন্দ্রীয় সরকার নমামি গঙ্গের 20 হাজার কোটি টাকা কি শুধু বারাণসীকে সাজাতে খরচ করবে ? কেন্দ্র শুধু ধর্ম আর জাতপাত ছাড়া কিছু জানে না ৷ আর রাজ্য সরকার খেলা, মেলা, উৎসব করতে ব্যস্ত ৷ গঙ্গাকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে ৷ কিন্তু এই নদী বাঁচাতে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না ৷”
বিলাইমারি পঞ্চায়েতের পশ্চিম রতনপুরের বাসিন্দা রামলাল চৌধুরী ৷ 40 বছর ধরে গঙ্গার প্রলয়ের সাক্ষী ৷ তাঁর কথায়, “এই মুহূর্তে গঙ্গা আর ফুলহারের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে মাত্র 900 মিটার ৷ 2023 সালেই দুই নদী মিলে যাবে ৷ তখন মহানন্দটোলা আর বিলাইমারি আর থাকবে না ৷ তলিয়ে যাবে রতুয়ার বিস্তীর্ণ অংশ ৷ আর এভাবেই চলতে থাকলে 20 বছরের মধ্যে মানচিত্র থেকে মালদার নাম মুছে যাবে ৷ ভূতনিতে গঙ্গা ভাঙন রোধের নামে শুধু পকেট ভরার কাজ হচ্ছে ৷ ভাঙন আটকাতে হলে নদীর তলদেশ পর্যন্ত কংক্রিটের ঢালাই করতে হবে ৷”
ভূতনির উত্তর চণ্ডীপুরের বাসিন্দা বঙ্কিম মণ্ডল বলছেন, “বর্ষা এলেই আমাদের আতঙ্ক শুরু হয়ে যায় ৷ প্রতি বছর একই ছবি ৷ ভূতনির একরের পর একর জমি নদীতে চলে যাচ্ছে ৷ গঙ্গা এখন অনেক চওড়া হয়ে গিয়েছে ৷ দিন গড়ানোর সঙ্গে ভাঙনের স্থায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে ৷ আর গঙ্গা-ফুলহার মিশে গেলে মালদা জেলাই নদীতে তলিয়ে যাবে ৷ সেচ দফতর যে কাজ করছে, তাতে সমস্যার সমাধান হবে না ৷ আমরা বাঁচতে চাই ৷ তাই কংক্রিটের মাধ্যমে গঙ্গা বাঁধা হোক ৷”