মালদা, 19 নভেম্বর : মালদা শহরের ভূগর্ভস্থ জলে মিশে রয়েছে আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডের মতো বিষ ৷ যা নিয়ে দু’দশক আগেই সতর্ক করেছেন বৈজ্ঞানিকরা ৷ সেই সতর্কবার্তা পেয়ে বাম আমলে ইংরেজবাজার পৌর এলাকায় আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল প্রকল্প তৈরি করার জন্য প্রায় 50 লাখ টাকা বরাদ্দও করে তৎকালীন রাজ্য সরকার ৷ কিন্তু জেলার রাজনৈতিক খেলায় সেই প্রকল্প চলে যায় পাশের পুরাতন মালদা পৌরসভায় ৷ সেখানে ইতিমধ্যেই ওই জল প্রকল্প তৈরি হয়ে গেছে ৷ ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল ৷
রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পর শেষ পর্যন্ত মালদা শহরবাসীর কথা ভেবে নতুন করে এই প্রকল্প তৈরি করতে উদ্যোগ নেন রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী ও ইংরেজবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরি ৷ মূলত তাঁর উদ্যোগেই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এই প্রকল্পের জন্য 42 লাখ টাকা বরাদ্দ করে ৷ প্রকল্পের কাজও শুরু করেন কৃষ্ণেন্দুবাবু ৷ ইতিমধ্যে মহানন্দা দিয়ে জল অনেক গড়িয়েছে ৷ শাসকদলের নেতা হলেও এখন কিছুটা যেন পিছনের সারিতে চলে গেছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু ৷ চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিতে হয়েছে তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী নীহাররঞ্জন ঘোষকে ৷ তাঁর অনুগামীদের বক্তব্য, কৃষ্ণেন্দুবাবু সরে যাওয়ার পর এই প্রকল্পও এখন কার্যত বিশবাঁও জলে ৷ কাজ পুরোপুরি বন্ধ না হলেও চলছে শম্বুকগতিতে ৷
শহরবাসীর দাবি, এই প্রকল্প আসলে শাসকদলের খুড়োর কল ৷ ভোট আসলে হঠাৎ করে জেগে ওঠে এই প্রকল্প ৷ প্রতিবারই 6 মাসের মধ্যে প্রকল্প চালু হয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি মেলে ৷ ভোট মিটলে মিলিয়ে যায় সেই বাজনা ৷ পৌরসভা দখলে রাখতে এটাই এখন শাসকদলের বড় ভরসা ৷ শুধু সাধারণ মানুষ নয়, একই কথা শোনা যাচ্ছে শাসকদলের কাউন্সিলর, পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারির গলাতেও ৷ ETV ভারতকে তিনি বলেন, "2006 সালে আমি যখন চেয়ারম্যান ছিলাম, তখনই এই প্রকল্পের টাকা এসে পড়ে ছিল ৷ আমার পর কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরি চেয়ারম্যান হন ৷ তিনি কিছুটা হলেও কাজটা করেছেন ৷ কিন্তু তাঁর পর যাঁরা চেয়ারম্যান হয়েছেন, তাঁরা আর এই প্রকল্প নিয়ে মাথা ঘামান না ৷ আমার দুঃখ হয়, 10 বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আমরা মালদা শহরের মানুষকে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল দিতে পারলাম না ৷ আমি যখন ইংরেজবাজারের চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন পুরাতন মালদা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন CPI(M)-র বিশ্বনাথ সুকুল ৷ রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী শৈলেন সরকার এই প্রকল্পের 50 লাখ টাকা ইংরেজবাজারকে না দিয়ে পুরাতন মালদাকে দিয়েছিলেন ৷ সেখানেই আমরা পিছিয়ে যাই ৷ এখনও এগোতে পারিনি ৷ আমার মনে হয়, ইংরেজবাজারের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য পদাধিকারিদের ব্যর্থতার জন্যই মালদা শহরের মানুষ আজ পর্যন্ত আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল পায়নি ৷ এই প্রকল্পের কাজ চললেও কাজের অগ্রগতি কিংবা কবে এই প্রকল্প চালু হবে তা জানতে পারিনি ৷ এই প্রকল্পকে সামনে রেখে দুটো ভোট গেছে ৷ আরেকটি ভোট চলে আসছে ৷ মানুষ সব মনে রেখেছে ৷ ভোটের আগে আমরা যদি এই পরিষেবা দিতে পারি, তবে হয়ত মানুষ আমাদের গ্রহণ করবে ৷ তা না হলে আমাদের প্রত্যাখ্যান করবে ৷"
এব্যাপারে পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান দুলাল সরকার বলেন, "এই পৌরসভা উত্তরবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল ৷ প্রথমে এই প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল 42 কোটি টাকা ৷ কিন্তু এখন প্রকল্প খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে 120 কোটি টাকা ৷ ইতিমধ্যে আমরা জলের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কাজ শেষ করে ফেলেছি ৷ নদী থেকে জল তোলার পাইপলাইন, 6টি ডেলিভারি ট্যাঙ্ক তৈরির কাজও শেষ ৷ কোতোয়ালির দৈবকিপুর প্ল্যান্টে এখন বিদ্যুতের কাজ চলছে ৷ বাড়ি বাড়ি পাইপলাইন সংযোগ করার কাজ দ্রুত শুরু হবে ৷ এর জন্য রাজ্য সরকার 25 কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে ৷ প্রায় 35 হাজার নতুন সংযোগ দেওয়া হবে ৷ এর দরপত্র আহ্বানও করা হয়েছে ৷ জানুয়ারি থেকে সেই কাজ শুরু হয়ে যাবে ৷ আমাদের আশা, আগামী এপ্রিলে আমরা শহরের কিছু অংশে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল পৌঁছে দিতে পারব ৷ তবে তার জন্য জনরোষ দেখা দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই ৷ আমরা দীর্ঘদিন থেকে 65-70টি পাম্পের সাহায্যে শহরের মানুষকে ভূগর্ভস্থ জল সরবরাহ করি ৷ এই শহরে জলের কোনও অভাব নেই ৷ তবে আমরা পরিস্রুত পানীয় জল এখনও বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে পারিনি ৷ সেই কাজ এখনও শেষ হয়নি ৷ আমার ওয়ার্ডে পাইপ লাইন বসানোর কাজ এখনও হয়নি ৷ আসলে চেয়ারম্যান আমার কাজ পরে করেন ৷ তবে শুরু হলে এক মাসের মধ্যে আমার ওয়ার্ডে কাজ শেষ করে দেব ৷"
এদিকে চেয়ারম্যান নীহাররঞ্জন ঘোষের বক্তব্য, "কে কী বলছে আমি জানি না ৷ এই প্রকল্পটি 2014 সালের ৷ আমি 2017 সালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছি ৷ আমরা 2020 সালের মধ্যে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি ৷ এই প্রকল্পের নকশা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে ৷ যেখান থেকে জল পরিস্রুত হয়ে আসবে, সেখানও একটা সমস্যা রয়েছে ৷ বেশ কিছু ওয়ার্ডে এখনও পর্যন্ত একটি পাইপও ফেলতে পারা যায়নি ৷ তার কারণ, 4 ইঞ্চির ডিস্ট্রিবিউশন পাইপ আমাদের হাতে নেই ৷ আমরা এনিয়ে পৌরমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছি ৷ বৈঠকে পাইপ কেনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ৷ ই-টেন্ডারও হয়ে গেছে ৷ আমরা এখন কলকাতা থেকে অর্ডার পাওয়ার অপেক্ষায় ৷ আজ যারা বলছে, ভোটের সময় আমরা এই প্রকল্প নিয়ে রাজনীতি করি, পাইপ বসানো না হলে তারাই বলবে, পাইপ বসানোর জন্য রাস্তা খোঁড়া হলেও কাজ হচ্ছে না ৷ আমরা আশা করছি, দ্রুত এই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারব ৷ প্রয়োজনে বিকল্প সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে ৷ তবে রেল দপ্তরের অসহযোগিতায় আমরা এই প্রকল্পের কিছু কাজ এখনও করতে পারিনি ৷ এ নিয়ে গতকালই আমি রেলকে চিঠি দিয়েছি ৷ আমি এই প্রকল্পে রাজনীতির বাধাও দেখতে পাচ্ছি ৷”