মালদা, 4 সেপ্টেম্বর : জীবনানন্দ লিখেছিলেন, "পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন, মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।" কবির সেই লেখা আজ যেন ভীষণই তাৎপর্যপূর্ণ। এর কারণ, করোনা। আনুবীক্ষণিক ভাইরাসের ধাক্কায় গোটা পৃথিবীই এখন অসুখে ভুগছে। এই অসুখ বহুমুখী। করোনা কেড়েছে প্রায় কয়েক লাখ মানুষের প্রাণ। পৃথিবীজুড়ে ভাইরাসের ধাক্কায় নাকাল কোটি কোটি মানুষ। যাঁরা ভাইরাসকে এড়াতে পেরেছেন, তাঁরাও অসুস্থতা এড়াতে পারেননি। অর্থনৈতিক সংকটে ভোগা বিশ্বে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন। পেটে খিদের জ্বালা নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন কত যে মানুষ!
এরই মধ্যে এগিয়ে আসছে বাংলার প্রাণের উৎসব। আকাশে শরতের মেঘ ভাসতে শুরু করেছে। নদী তীরে কাশের ছোঁয়াও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। জেলায় জেলায় কুমোরটুলিতে বাড়ছে ব্যস্ততা। তিল তিল করে মৃন্ময়ীকে গড়ে তুলছেন মৃৎশিল্পীরা। কিন্তু তাঁরাও করোনার ধাক্কায় স্তব্ধ। মালদার বেশ কিছু শিল্পী এবার কোনও মাতৃমূর্তির বরাত পাননি। প্রতিমার দামও পাচ্ছেন না তাঁরা। কীভাবে চলবে? চিন্তায় ঘুম নেই তাঁদের।
আরও পড়ুন : Gramophone : ভয়েজ কমান্ডের যুগেও সন্তান স্নেহে গ্রামোফোনকে আঁকড়ে রয়েছেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী
মালদা জেলায় কমবেশি হাজার দেড়েক দুর্গাপুজো হয়। জানা যাচ্ছে, গতবার থেকে সেই সংখ্যাটা কমতে শুরু করেছে। এর কারণ অবশ্যই করোনা। মানুষের কাজ নেই। খাবার জোগাড় করতেই দিন কেটে যাচ্ছে। তাও ঘরের সবার পেট ভরে না। এই অবস্থায় পুজো কীভাবে হবে ? পুজো কমিটিগুলিকে সরকার 50 হাজার টাকা করে দিচ্ছে। এই বাজারে সেই টাকায় দুর্গাপুজোর আয়োজনের চিন্তা নেহাতই আকাশকুসুম কল্পনা। পুজো উদ্যোক্তারাও মানুষের হাতে চাঁদার কাগজ তুলে দিতে ইতস্তত করছেন। ফলে পুজোর সংখ্যা কমছে। তবু জেলার নামী মৃৎশিল্পীদের কাজ রয়েছে। অনেক শিল্পী সময় পাবেন না বলে বরাত ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এমনও কিছু শিল্পী রয়েছেন, যাঁদের দিন কেটে গিয়েছে খদ্দেরের প্রত্যাশায়। এখনও মেলেনি একটি প্রতিমারও বরাত।
মালদা জেলায় স্বনামধন্য মৃৎশিল্পীদের কথা উঠলে যে দুটি নাম সামনের সারিতে উঠে আসে, তাঁরা হলেন লালমোহন পণ্ডিত ও বিশ্বনাথ পণ্ডিত। এই দু'জনের হাত ধরে কত মৃৎশিল্পী যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
আরও পড়ুন : Garden Library in Kolkata : অভিনন্দন মন্ত্রীর, নিরাপত্তারক্ষীর উদ্যোগে জগৎ মুখার্জি পার্কে আস্ত গ্রন্থাগার
সেই লালমোহন পণ্ডিতের ছেলে স্বপন পণ্ডিত এবার একটি দুর্গা প্রতিমারও বরাত পাননি। তিনি বলেন, "করোনা আমার কাজ কেড়ে নিয়েছে। গতবার তিনটি প্রতিমা বানিয়েছিলাম। এবার একটি প্রতিমারও বরাত পাইনি। পরিস্থিতি খুব ভয়ঙ্কর। ছোট অন্য প্রতিমা তৈরি করছি। তারও ঠিক দাম পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ দাম বাড়াতে চাইছে না। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যত কী হবে, জানি না। সরকারি কোনও সহায়তা এখনও পাইনি। এবার দুর্গা প্রতিমা বানাতে না পেরে একদিকে যেমন শিল্পী হিসাবে খারাপ লাগছে, তেমনই সংসার কীভাবে চলবে, তা নিয়েও বড্ড দুশ্চিন্তায় রয়েছি।"
জেলার আরেক মৃৎশিল্পী চন্দন পণ্ডিতেরও এক দশা। তিনি জানান, "35 বছর ধরে মৃৎশিল্পী হিসাবে কাজ করছি। এবার কোনও দুর্গা প্রতিমার বরাত পাইনি। এমন পরিস্থিতি কখনও হয়নি। করোনার জন্য মানুষ পুজোর আয়োজন করতে ভয় পাচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। আর হাতে মাত্র এক মাস সময়। এর মধ্যে কেউ মূর্তির বরাত দিতে আসবে কিনা জানি না। আমি খদ্দেরের অপেক্ষা করে যাচ্ছি। এবার অনেকেই পুজো ছোট করে দিচ্ছে। কেউ বড় পুজো করলেও মূর্তির যে দাম দিতে চাইছে, তাতে কাজ করা সম্ভব নয়। সেই টাকায় মূর্তি বানানোর খরচটাই উঠবে না।"
আরও পড়ুন : Jute Cultivation : পাটের দাম পাচ্ছেন না চাষিরা, সরকারি নিস্পৃহতায় পকেট ভরছে ফড়েদের
তিনি আরও বলেন,"পরিস্থিতিটা একেবারেই ভাল না। এই বয়সে পেশাও বদল করতে পারব না। ছোটখাটো কিছু মূর্তি বানাচ্ছি। তার দামও সবাই কম দিচ্ছে। কিন্তু সংসার তো চালাতে হবে। তাই কম টাকাতেই মূর্তি বানাচ্ছি। অন্য কোনও আয়ের জায়গাও নেই আমার। এই অবস্থায় একমাত্র সরকার কিছু ভাবলেই আমরা ঠিকমতো বাঁচতে পারি। সেই সহায়তা এখনও পাইনি। করোনাকালে রেশনের সামগ্রী দিয়ে পেট চলছে। এর বেশি আর কিছু নেই। এভাবে চললে আমার পক্ষে এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখাই দায়। দেখা যাক, কী হয়।"
শরতের শুরুতে বঙ্গভূমি আলোয় আলোয় আকাশ, আকাশ তারায় ভরা। বাঙালি এখন আনন্দ আয়োজনে মেতেছে। কিন্তু সেই আয়োজনের মূল চাবিকাঠি যাঁদের হাতে, তাঁরাই এখন আঁধারে। দাবি উঠেছে, শুধু পুজো উদ্যোক্তাদের নয়, সরকারি সাহায্য পৌঁছাক দুঃস্থ মৃৎশিল্পীদের ঘরেও। তবেই উৎসবের আয়োজন সম্পূর্ণ হবে।