মালদা, 9 জুন : বারান্দায় একের উপর এক ঝাঁপি রাখা ৷ এখনও বীণ বাজে ৷ কিন্তু ঝাঁপি থেকে মাথা বের করে কেউ দোলায় না ৷ 1972 সালের আইন এখন অনেক কড়া ৷ সেই বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনে এখন সাপখেলা দেখানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ ৷ ফলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সর্পকুল ৷ কিন্তু এতে পেটের দানা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে সাপুড়েদের বা বেদে সম্প্রদায়ের ৷ করোনাকালে ভিক্ষা ছাড়া তাঁদের আর কোনও গতি নেই ৷ সেটাও রোজ জোটে না ৷ তাই কোনওদিন আধপেটা খাবার, তো কোনওদিন নলকূপের জলই ভরসা ৷ খিদের জ্বালায় বাচ্চারা কাঁদলে চড়, চাপড় ছাড়া আর কিছু জোটাতে পারেন না অভিভাবকরা ৷ এই পরিস্থিতিতে খাবারের জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বেদেরা ৷ তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন খাকি উর্দিধারীরা ৷ পুলিশের তরফে তুলে দেওয়া হয়েছে সামান্য কিছু সাহায্য ৷
মালদার চাঁচল- 2 ব্লকের কাণ্ডারণ গ্রাম ৷ প্রায় 200 ঘর বেদের বসবাস ৷ কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে প্রায় 1200 মাথা ৷ এঁরা শুধু সাপ ধরে খেলা দেখাতেই জানেন ৷ অন্য কাজ তাঁদের জানা নেই ৷ কিন্তু সাপখেলা এখন নিষিদ্ধ ৷ এক্ষেত্রে বন দফতরও কঠোর ৷ পরিস্থিতি বুঝে কয়েকজন ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছেন ৷ তবে বেশিরভাগই বাড়িতে ৷
এরই মধ্যে এসেছে করোনা ৷ প্রথম পর্যায়ের লকডাউন কেটেছে ৷ এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের কঠোর বিধিনিষেধ ৷ সাপখেলা দেখানো দূরের কথা, কোনও কাজকর্মই নেই ৷ তাই ভিক্ষা করেই দিন কাটছে বেদেদের ৷ খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে দু’দিন আগে গোটা চারেক সাপ নিয়ে গাজোলের একটি গ্রামে খেলা দেখাতে গিয়েছিলেন দু’জন ৷ একজনকে পাকড়াও করে পুলিশ ৷ বন দফতর পরে ধৃত মাজিত বেদেকে আদালতে তুলেছে ৷ তিনি এখন সংশোধনাগারে ৷ এই অবস্থায় চাঁচল থানার পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে এই অভাবী বেদেদের পাশে ৷ কিছু খাদ্যসামগ্রী আর করোনা থেকে বাঁচার উপকরণ তুলে দেওয়া হয়েছে এই মানুষগুলোর হাতে ৷
চাঁচল থানার আইসি সুকুমার ঘোষ জানাচ্ছেন, “লকডাউন পরিস্থিতিতে চরম সমস্যায় রয়েছেন গরিব এই মানুষগুলো ৷ এঁদের কয়েকজন আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন ৷ সেই আবেদনে সাড়া দিয়েই আমরা আজ তাঁদের হাতে কিছু সামগ্রী তুলে দিচ্ছি ৷ এলাকার কিছু ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষও আমাদের সাহায্য করেছেন ৷ অপুষ্টের শিকার বাচ্চা ও গর্ভবতীদের জন্য হেল্থ ড্রিংকসও দেওয়া হয়েছে ৷ তবে সাপের খেলা আইনবিরুদ্ধ ৷ সেটা নিয়ে আমরা কিছু করতে পারব না ৷’’
কিন্তু তাৎক্ষণিক সাহায্য নয়, বেদেরা চাইছেন তাঁদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান ৷ সাপখেলা দেখাতে গিয়ে ধৃত মাজিত বেদের স্ত্রী রোজিয়া বেদে বলছেন, “আমাদের চোদ্দ পুরুষ সাপ নিয়েই বাঁচল ৷ সাপ নিয়েই মরল ৷ আমাদের আর কোনও কাজ জানা নেই ৷ গাছতলায় আমাদের জন্ম ৷ সাপ ধরে খেলা দেখিয়েই পুরুষরা সংসার চালায় ৷ যেদিন থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে, আমাদের মরণ এসেছে ৷ খেতে পাচ্ছি না ৷ ভিক্ষা চাইতে যাচ্ছি ৷ কিন্তু তারাই বা কতদিন ভিক্ষা দেবে? পেটের জ্বালায় আমাদের দু’জন সাপখেলা দেখাতে গিয়েছিল ৷ ফরেস্টের লোক ওঁদের ধরে নিয়ে গিয়েছে ৷ আমরা সবার পায়ে পড়েছি, কিন্তু আমার লোককে ছাড়েনি ৷ আমাদের দুঃখ দেখে চাঁচল থানার পুলিশ চাল-ডাল দিয়ে যাচ্ছে ৷ কিন্তু এতে ক’দিন চলবে? আমাদের কাজ দেওয়া হয় না ৷ চাকরি পাই না ৷ তাই আমরা সাপের খেলাই দেখাতে চাই ৷ আমাদের কিছু ছিল না ৷ যেটুকু আছে, তা সরকারই দিয়েছে ৷ তাহলে সরকার তো আমাদের বিষয়ে সবই জানে ৷ তারপরও আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন ?”
আরও পড়ুন : খাদ্যসামগ্রী দিয়ে 250 দুস্থ পরিবারের পাশে পুলিশ কর্মীদের স্ত্রীরা
করিম বেদের বক্তব্য, “যতদিন সাপখেলা দেখানো গিয়েছে, আমাদের সংসারও খুব ভালো চলেছে ৷ ছেলেমেয়েরাও মানুষ হচ্ছিল ৷ কিন্তু আইন যেদিন থেকে কার্যকর হয়েছে, সেদিন থেকেই থেকেই আমরা চরম সমস্যায় পড়েছি ৷ এখানে 150-র বেশি পরিবার সাপখেলা দেখাত ৷ সবাই এখন ভিক্ষা করে দিন কাটাচ্ছে ৷ তারপরও আমাদের ঘরের কয়েকজন ছেলে স্নাতক হয়েছে ৷ কিন্তু তারাও সরকারি সুযোগ সুবিধে পাচ্ছে না ৷ চাকরি পাচ্ছে না ৷ আমরাও চাই, আমাদের সমাজ এগিয়ে যাক ৷ তার জন্য সরকারি কিংবা রাজনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন ৷ আমরা তারই আর্জি জানাচ্ছি ৷’’