মালদা, 23 অক্টোবর : উৎসবের মরশুমেও অশান্ত কাশ্মীর। ভূস্বর্গে চলছে জঙ্গিদের গুলি। শুধু কাশ্মীরি কিংবা সেনাই নয়, এবার তাদের নিশানায় পরিযায়ী শ্রমিকরাও । গত শনিবার শ্রীনগরে জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন বিহার ও উত্তরপ্রদেশের দুই শ্রমিক । রবিবার কুলগ্রামে বাড়িতে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে জঙ্গিরা খুন করেছে আরও দুই শ্রমিককে, জখম আরও একজন । এক্ষেত্রেও মৃতরা বিহারের বাসিন্দা ছিলেন ।
পরপর এমন ঘটনার পর আর ঝুঁকি নিতে চাইছেন না সেখানে কর্মরত মালদার পরিযায়ী শ্রমিকরা । নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের আপাতত কাশ্মীরে না থাকার পরামর্শ দিচ্ছে সেখানকার পুলিশ-প্রশাসনও । তাই প্রাণ হাতে নিয়ে পরিযায়ীরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন ।
আরও পড়ুন : Malda : শিক্ষক নির্যাতনে মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতার গ্রেফতারির দাবিতে মালদায় আদিবাসীদের অবরোধ
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে মালদাতেই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি । গোটা দেশেই ছড়িয়ে রয়েছেন এই জেলার শ্রমিকরা । জম্মু ও কাশ্মীরেও বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক কর্মরত । তাঁদের সিংহভাগই কালিয়াচক 1 নম্বর ব্লকের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা । এই শ্রমিকদের কেউ সেখানে রাজমিস্ত্রি, কেউ কুয়ার রিং তৈরি করেন, কেউ বা আপেল ও আখরোটের বাগানে কাজ করেন । গত মার্চে তাঁরা কাশ্মীর গিয়েছেন । আগামী মার্চে তাঁদের বেশিরভাগের বাড়ি ফেরার কথা ছিল । কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি তাঁদের বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য করছে ।
গতকালই কাশ্মীর থেকে ঘরে ফিরেছেন বেশ কিছু শ্রমিক । তাঁরা মূলত কালিয়াচকের দারিয়াপুর, সালেপুর, শেরশাহী প্রভৃতি এলাকার বাসিন্দা । আজ উত্তর দারিয়াপুরের নয়াবস্তি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রাণ বাঁচাতে পেরে তাঁরা খুশি হলেও সংসার কীভাবে চলবে, সেই চিন্তায় মগ্ন ।
আরও পড়ুন : TMC Leader Murder: তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি খুনে চেন্নাইয়ে গ্রেফতার শার্প শুটার
তাঁদের একজন আলি আসগর বলেন, “গত মার্চে আমরা পাঁচ ভাই কাশ্মীর গিয়েছিলাম । পুলওয়ামা জেলার একটি গ্রামে কুয়োর রিং তৈরি করতাম । পাঁচ ভাই মিলেই ব্যবসা শুরু করেছিলাম । গত শনি ও রবিবার জঙ্গিদের গুলিতে পরিযায়ী শ্রমিকরা মারা যান । এরপরেই পুলিশ আমাদের থানায় নিয়ে যায় । পুলিশ আমাদের সাফ জানায়, এখন জঙ্গিরা বাইরের লোকদেরও গুলি চালিয়ে মেরে ফেলছে । তাই এখন আর কাজ করা যাবে না । কারা এমন করছে এখনও জানা যাচ্ছে না । আমাদের উপরেও যে কোনও সময় হামলা হতে পারে । তাই পুলিশ, এমনকি কাশ্মীরিরাও আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত । পুলিশ আমাদের বাড়ি ফেরার কথা জানায় ।’’
একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘পুলিশের তরফে একটি স্কুলে একদিন আমাদের রাখা হয়েছিল । পরদিন পুলিশই গাড়ি ঠিক করে নিরাপত্তার বেষ্টনীতে আমাদের জম্মু রেল স্টেশনে পাঠিয়ে দেয় । সেখান থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরেছি । এখানকার 7-8 হাজার শ্রমিক কাশ্মীরে বিভিন্ন কাজ করেন । তাঁরা সবাই বাড়ি ফিরে আসছেন । এর আগে ফৌজিদের সঙ্গে ওদের ঝামেলা হয়েছিল । কিন্তু বাইরের কাউকে তারা মারেনি । এবার ওরা বাইরের লোকদেরও মেরে ফেলছে । আমরাও এনিয়ে চিন্তায় ছিলাম । বিহারি-বাঙালিকেও এবার ওরা নিশানা বানিয়েছে । কবে এই পরিস্থিতি ঠিক হবে জানি না । সেখানে আমাদের অন্তত চার লাখ টাকার মাল ফেলে এসেছি । তাই হাল কিছুটা ঠিক হলেই আমাদের কাশ্মীর ফিরে যেতে হবে ।”
আরও পড়ুন : Snake Bite : গৃহস্থ বাড়ি থেকে সাপ ধরতে গিয়ে ছোবলে মৃত সর্পপ্রেমী
কাশ্মীর থেকে ঘরে ফিরে আসা মহম্মদ আলি আকবর বললেন, “পরিস্থিতি এখন ভাল নয় । কাশ্মীরের পুলিশও আমাদের সেখানে কাজ করতে দিতে চাইছে না । আমাদের নিরাপত্তার জন্যই সেখানকার পুলিশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে । কারণ, এখন সেখানে ভিনরাজ্যের শ্রমিকদেরও ওরা মেরে ফেলছে । হোয়াটসঅ্যাপে জঙ্গিদের কাজকর্মের নমুনা আমরা দেখেছি । ফলে প্রাণের ভয় আমাদেরও ছিল । এরই মধ্যে দিন চারেক আগে বাড়িওয়ালা আমাদের ফোন করে থানায় যোগাযোগ করতে বলেন । থানায় গেলে পুলিশ আমাদের বাড়ি ফিরে আসতে বলে । আমি সোপিয়ান জেলায় কাজ করতাম । কবে সেখানে ফিরতে পারব, সেটাই ভাবছি । পরিস্থিতি ঠিক হলেই ফের কাশ্মীর যাব ।”
ঘরে ফিরে আসা আরেক শ্রমিক মহম্মদ সামসুজ্জামান বলেন, “এই গ্রামের প্রায় সব শ্রমিকই কাশ্মীরে কুয়োর রিং তৈরি করে । আমরা পুলওয়ামা জেলায় কাজ করছিলাম । সেখানে পরিস্থিতি কুলগ্রামের মতো ছিল না । একদিন কাজ সেরে ঘরে ফিরে এলাকার এক শ্রমিকের কাছ থেকে ফোনে জানলাম, পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে গিয়েছে । তবে আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়নি । পরদিন ফের কাজে যাই । সেদিন জানতে পারি, নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ আমাদের আর সেখানে কাজ করতে দিতে চাইছে না । তাই চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে এসেছি । ওখানে ট্রেনের টিকিটের এখন ভীষণ চাহিদা । অনেক বেশি টাকায় টিকিট মিলছে । সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায় । এই গ্রামেরই অন্তত 400 জন সেখানে কাজ করছেন । তাঁরা সবাই বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন ।”
আরও পড়ুন : Amit Shah : নজরে নিরাপত্তা, তিনদিনের সফরে শনিবার শ্রীনগর পৌঁছালেন অমিত শাহ
পাঁচ ছেলে ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে আসায় খুশি মহম্মদ বাসেদ আলি । কিন্তু ছেলেদের উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কীভাবে সংসারের চাকা ঘুরবে তা নিয়ে চিন্তায় তিনি । বললেন, “পাঁচ ছেলে দীর্ঘদিন ধরেই কাশ্মীরে কাজ করে । তাদের রোজগারেই আমাদের সংসার চলে । থানায় ডেকে পুলিশ হঠাৎ করেই তাদের বাড়ি ফিরে আসতে বলে । গোলমালের জন্যই পুলিশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে । কিন্তু পাঁচ ছেলের কেউ টাকা-পয়সা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেনি । ওখানে তাদের অন্তত দেড় হাজার রিং তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে । এখন কীভাবে চলবে তা আল্লাহই জানেন । রাজ্য সরকারের কাছে আমার আবেদন, এই পরিস্থিতিতে সংসার চালাতে আমাদের কিছু আর্থিক সাহায্য করা হোক ।”