মালদা, 3 জুন: ফজরের নমাজ পড়া শেষ হয়েছে সবে মাত্র ৷ সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের রিং-টোন বেজে উঠেছে ৷ তা শুনে ছুটতে ছুটতে এসে ফোনটা ধরেছিলেন হেনারা বিবি ৷ ফোনের স্ক্রিনে ছেলের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি ৷ মুহূর্তের মধ্যে গ্রামে চাউর হয়ে যায়, মাশকেরুল আর নেই ৷ সেই খবর পৌঁছতেই নেমে আসে নিস্তব্ধতা ৷
গতকাল রাতেই হেনারা বিবি খবর পেয়েছিলেন, চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ৷ তারপর থেকেই মায়ের মন উচাটন ছিল ৷ সঙ্গে থাকা লোকজনকে ফোন করে ছেলের খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ৷ কিন্তু সারারাত ছেলের খোঁজ পাননি ৷ অবশেষে শনিবার ভোরে ছেলের খোঁজ পেয়েছেন মা এবং স্বামীর খোঁজ পেয়েছেন রুকসানা ৷ এক লহমায় খাতুন থেকে বেওয়া হয়ে গিয়েছেন রুকসানা ৷
চাঁচল 2 নম্বর ব্লকের ধানগাড়া বিষ্ণুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বালিয়াঘাট পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মাশকেরুল রহমান ৷ বয়স মাত্র 26 বছর ৷ বাড়িতে বাবা-মা ও স্ত্রী ছাড়াও রয়েছে সাত বছরের ছেলে আর 13 মাসের মেয়ে ৷ এলাকায় সেভাবে কাজ না-থাকায় সংসার ঠিকমতো চলছিল না ৷ উপার্জনের আশায় চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন মাশকেরুল ৷ সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন ৷ যারা ওই এলাকারই ৷ সকলেই চেন্নাই যাওয়ার জন্য উঠে পড়েছিলেন অভিশপ্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে ৷ কে জানত যাদের ভালো রাখতে ঘর ছাড়ছেন তাদেরই আর দেখতে পাবেন না ৷ এখনও নিখোঁজ ওই অঞ্চলেরই আরও তিন শ্রমিক জামিরুল ইসলাম, মিনতাউল হক ও নুরুল ইসলাম ৷
আরও পড়ুন : করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় বেঁচে ফিরলেন শ্বশুর-বৌমা, ক্যানিং হাসপাতালে ভরতি
মাশকেরুলের মা হেনারা বিবি বলেন, "এখানে ধান, পাট কাটত ৷ একবার উপর থেকে মাথায় ইট পড়েছিল ৷ তা থেকে স্নায়ুর রোগ ধরা পড়েছিল ৷ তাই এলাকায় যা কাজ পেত, সেটাই করত ৷ ভিনরাজ্যে কখনও কাজে যায়নি ৷ কিছুদিন আগে বলে, বেশি রোজগার করতে চেন্নাই যাবে ৷ বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ৷ গতকাল রাত ন’টা নাগাদ খবর আসে, যে ট্রেনে ওরা চেন্নাই যাচ্ছিল, সেই ট্রেনটা নাকি উলটে গিয়েছে ৷ সঙ্গে সঙ্গে সবাই ফোন চালাচালি করতে থাকে ৷ ওর শ্যালকও সঙ্গে ছিল ৷ সে জানায়, মাশকেরুলকে সবাই খুঁজছে ৷ কিন্তু ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না ৷ অবশেষে শনিবার ভোর পাঁচটায় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ছেলের দেহের ছবি দেখি ৷"
আরওপড়ুন: করমণ্ডলে এক্সপ্রেসে ছিলেন 4 সদস্য, আশঙ্কায় গোসাবার পরিবার
ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর মা ৷ আবার স্বামী যে হঠাৎ এভাবে না ফেরার দেশে পাড়ি দেবেন, কখনও ভাবেননি মাশকেরুলের স্ত্রী রুকসানা খাতুন ৷ শোকস্তব্ধ রুকসানা ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না ৷ জানালেন, "গতকাল দুপুরেও আমার সঙ্গে কথা হল ৷ খাবার খেল কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম ৷ তখন ট্রেনেই ছিল ৷ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ৷ হঠাৎ শুনি, ট্রেন দুর্ঘটনার পর ওর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না ৷ শেষ পর্যন্ত আজ ভোরে জানতে পরি, ও আর নেই ৷ ও কোনওদিন বাইরে কাজে যায়নি ৷ অসুস্থ ছিল ৷ এখানেই যা কাজ পেত, করত ৷ প্রথমবার বাইরে যাওয়ার সময়ই যে এই ঘটনা ঘটবে, কল্পনাতেও আসেনি ৷ এখন বাচ্চা দুটোকে কীভাবে মানুষ করব, সেটাই ভাবছি ৷"