মালদা, 5 নভেম্বর : সেন আমলে বাংলার রাজধানী গৌড়ের প্রবেশমুখে মাটির নীচ থেকে উঠে এসেছিল পাথরের তৈরি এক দেবীমূর্তি ৷ পাতাল থেকে দেবীমূর্তি বেরিয়ে আসায় দেবীর নাম হয় পাতালচণ্ডী ৷ অবশ্য শুধু এখানেই নয়, তৎকালীন গৌড়ের চারটি প্রবেশমুখেই এমন দেবীমূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ৷ বাকি তিনটি দেবীর নাম জহুরাচণ্ডী, মাধাইচণ্ডী ও দুয়ারবাসিনী ৷ তৎকালীন গৌড়ের নৃপতিরা ধরে নেন, এই দেবীরাই যাবতীয় বিপদ থেকে এলাকাকে রক্ষা করে আসছেন ৷ তাই তাঁদের উদ্যোগে চার জায়গায় নির্মিত হয় মন্দির ৷ এর মধ্যে জহুরাচণ্ডী ও মাধাইচণ্ডী মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা থাকলেও পাতালচণ্ডী ও দুয়ারবাসিনী যাওয়ার ভালো রাস্তা এখনও তৈরি হয়নি ৷ পর্যটকরা চাইলেও সহজে এই দুই মন্দিরে সহজে যাতায়াত করতে পারেন না ৷ ফলে জেলার ইতিহাস পর্যটনের মানচিত্রে এতদিন যেন ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে পাতালচণ্ডী ও দুয়ারবাসিনী ৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন ৷ পাতালচণ্ডী মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা তৈরির কাজে হাত পড়েছে ৷ গতকাল সেই কাজের শিলান্যাস করেন ইংরেজবাজারের বিধায়ক নীহাররঞ্জন ঘোষ ৷ ছিলেন BDO সৌগত চৌধুরিসহ প্রশাসনিক আধিকারিকরা ৷
ইংরেজবাজার ব্লকের মহদিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে অবস্থিত পাতালচণ্ডী মন্দির ৷ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে ১৩০০ মিটার ভিতরে আমবাগানে ঘেরা এক জায়গায় মন্দিরের অবস্থান ৷ মন্দিরের একপাশে ১০০ বিঘার এক জলাশয় ৷ এই জলাশয়টি মন্দিরের বলেই দাবি স্থানীয়দের ৷ এনিয়ে বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা চলছে ৷ প্রতি বছর এই মন্দিরে বাসন্তীপুজো হয়ে থাকে ৷ বৈশাখ মাস জুড়ে চলে চণ্ডীর আরাধনা ৷ সেই সময় জেলা ছাড়িয়ে রাজ্য, এমনকি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে উপস্থিত হয় পূণ্যার্থীরা ৷ কিন্তু জাতীয় সড়ক থেকে মন্দির পর্যন্ত কোনও রাস্তা না থাকায় তাদের যথেষ্ট সমস্যার মুখে পড়তে হয় ৷ তাই মন্দিরে যাতায়াতের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে আবেদন জানিয়ে আসছিল এলাকার মানুষজন ৷ একই সঙ্গে তারা মন্দিরে বিদ্যুৎ সংযোগ ও নিরাপত্তার দাবিও তুলেছিল ৷ একই দাবি তুলেছিল পর্যটকরাও ৷ কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সেই দাবিকে এতদিন কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি ৷
শেষ পর্যন্ত বিধায়কের উদ্যোগে এলাকার মানুষ ও পর্যটকদের দাবিকে মান্যতা দিতে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন ৷ আজ মন্দির থেকে জাতীয় সড়ক পর্যন্ত রাস্তার একাংশের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে নীহারবাবু বলেন, "এতদিন এনিয়ে কেন কেউ কোনও উদ্যোগ নেয়নি তা আমি বলতে পারব না ৷ তবে এখানকার মানুষ ও মায়ের ভক্তরা যখন আমাকে এই সমস্যার কথা জানায়, তখনই আমি এখানে একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য চেষ্টা চালাই ৷ আপাতত ৩০ লাখ টাকা জোগাড় করতে পেরেছি ৷ সেই টাকা দিয়েই প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৬৫০ মিটার রাস্তা তৈরি হবে ৷ বাকি রাস্তা যাতে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে করে দেওয়া যায় তার জন্য BDO-কে আবেদন করেছি ৷ প্রয়োজনে এনিয়ে জেলাশাসকের কাছেও আবেদন জানাব৷ আগামী এক বছরের মধ্যে এই রাস্তার কাজ আমি শেষ করতে চাই ৷ শুধু তাই নয়, এখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই ৷ তা নিয়ে আজ আমি এখান থেকে বিদ্যুৎ দপ্তরের আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলেছি ৷ এখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে কত টাকা প্রয়োজন তা নিয়ে তাঁকে একটি রিপোর্ট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছি ৷ ওই রিপোর্ট পেলে আমি নিজের বিধায়ক উন্নয়ন তহবিল থেকে টাকার ব্যবস্থা করে দেব ৷ রাস্তা এবং আলোর ব্যবস্থা হলে গেলেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে ৷ প্রয়োজনে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে এখানে একটি পুলিশ ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা যেতে পারে ৷ যাই হোক না কেন, পাতালচণ্ডীকে ভক্ত ও পর্যটকদের সামনে উন্মুক্ত করাই আমাদের লক্ষ্য ৷"
রাস্তার কাজ শুরু হওয়ায় বিধাককে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এলাকার বাসিন্দা, RSS-এর অন্যতম কর্তা তরুণ পণ্ডিত ৷ তিনি বলেন, "এটা একটা ঐতিহাসিক জায়গা ৷ বাসন্তীপুজোয় এখানে প্রচুর মানুষ আসে ৷ এই মন্দিরে যাতায়াতের জন্য বিধায়ক যে উদ্যোগ নিয়েছেন তার জন্য তাঁকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি ৷ শুধুমাত্র রাস্তার অভাবে এই মন্দিরে অনেক মানুষ আসতে পারত না ৷ এখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার জন্যও বিধায়ক আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন ৷ গৌড়ের গাইড ম্যাপে পাতালচণ্ডীর উল্লেখ রয়েছে ৷ কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এতদিন এই জায়গাটি উপেক্ষিত ছিল ৷ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে প্রচুর পর্যটক এখানে আসবে ৷ এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ৷ মন্দিরের পাশে যে ঝিল রয়েছে, তাতে যদি বোটিং-এর ব্যবস্থা করা যায় তাহলে প্রচুর মানুষ এখানে আসবে ৷”
Conclusion:বিডিও সৌগত চৌধুরি বলেন, “পাতালচণ্ডী ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা৷ এই মন্দিরে আসার জন্য কোনও পাকা রাস্তা নেই৷ তাই বিধায়কের আবেদনে আমরা বর্ডার এরিয়া ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে এই রাস্তা তৈরির আবেদন করেছিলাম৷ সেখান থেকে ৬১৮ মিটার রাস্তা তৈরির অনুমোদন পাওয়া গেছে৷ তার জন্যঠ বরাদ্দ হয়েছে ৩০ লক্ষ টাকা৷ এর সঙ্গে বিধায়ক তাঁর উন্নয়ন তহবিল থেকে আরও ৫ লক্ষ টাকা অনুমোদন করেছেন৷ সেই টাকায় আরও ১০০ মিটার রাস্তা তৈরি করা যাবে৷ অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে ১৩০০ মিটারের মধ্যে ৭১৮ মিটার রাস্তা তৈরি করা হবে৷ বাকি রাস্তা ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে তৈরি করা যায় কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখছি৷ আশা করা যাচ্ছে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে রাস্তার কাজ শেষ হয়ে যাবে৷ বিদ্যুতের জন্যও আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি৷”