মালদা, 21 জুন : "আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি ৷ দুধে আমসত্ত্ব ফেলে কলা দিয়ে মেখে...আহা ৷"-- এ যে কী অমৃত খাওয়া তা বাঙালিকে বুঝিয়েছিলেন কবিগুরু ৷
অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই মালদায় তৈরি হচ্ছে আমসত্ত্ব ৷ শুধু দুধে মিশিয়ে নয় খাওয়া নয়, বাঙালি রান্নাতেও এর বহুল ব্যবহার ৷ বাঙালির হেঁশেলে আমসত্ত্ব নেই, এমনটা খুব একটা দেখা যায় না ৷ এক সময় মুঘল বাদশারাও আমসত্ত্বের স্বাদে মজেছিলেন ৷ শোনা যায়, মালদার আমসত্ত্বের স্বাদ নাকি বাকিংহাম প্যালেসও পেয়েছে ৷
কিন্তু কয়েকশো বছরের প্রাচীন, মালদার এই আমসত্ত্ব শিল্প এখনও সেভাবে বাজার পায়নি ৷ এমনিতে প্রতি বছর ভিন রাজ্যে হওয়া ফুড মেলাগুলিতে মালদার আমসত্ত্ব বেশ বাহবা পায় ৷ তাই সঠিক প্যাকেজিং, হাইজিনের দিকটি খেয়াল রেখে ঠিকঠাক বাজারজাত করতে পারলে অন্তত বছরে 100 কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে ৷ কিন্তু এর জন্য সরকারি সহায়তার বিশেষ প্রয়োজন ৷ মালদায় প্রায় 32 হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয় ৷ অন ইয়ারে আমের ফলন তিন লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যায় ৷
এবারও জেলায় অন্তত সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা ৷ ফলন ভাল হওয়ায় এবার আমসত্ত্ব তৈরিতে জোর কদমে নেমে পড়েছেন জেলার মহিলারা ৷ কারণ আমসত্ত্ব তৈরিতে মহিলারাই বেশি দক্ষ ৷ মালদার কালিয়াচক থেকে হরিশ্চন্দ্রপুর, আমসত্ত্ব তৈরি হয় সব জায়গাতেই ৷ তবে রং ও স্বাদে সবার প্রথমে নাম আসে ইংরেজবাজারের কোতোয়ালি, টিপাজানি, ধানতলা প্রভৃতি এলাকার তৈরি আমসত্ত্ব ৷ আম থেকে তৈরি এই আমসত্ত্বে দাম মান অনুযায়ী কিলো প্রতি 700 টাকা থেকে দু’হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে ৷
খেতে যতটা সুস্বাদু, আমসত্ত্ব তৈরি করার প্রক্রিয়া মোটেও ততটা সরল নয় ৷ দু কেজি আমসত্ত্ব তৈরি করতে 35 থেকে 40 কিলো ভাল মানের আমের প্রয়োজন হয় ৷ বারবার মুছে অল্প অল্প করে রস দিয়ে প্রলেপ দিতে হয় ৷ এতে যেমন সময় লাগে তেমনই পরিশ্রম রয়েছে ৷ আমসত্ত্ব তৈরি করতে কারিগরদের প্রয়োজন ৷ ফলে পরিশ্রম ও কারিগরদের টাকা মিটিয়ে হাতে লাভ তেমন থাকে না ৷ পাশাপাশি এ-বছর মালদায় প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে ৷ এতে প্রচুর আম নষ্ট হয়েছে ৷ আমসত্ত্ব শুকোতেও কড়া রোদের প্রয়োজন ৷ সব মিলিয়ে বিপাকে মালদার আমসত্ত্ব কারিগররা ৷
আরও পড়ুন : মালদা থেকে দিল্লি, ফলের রাজার রাজকীয় যাত্রা
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের তরফে কিছু স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীকে আমসত্ত্ব তৈরির কাজ দেওয়া হয়েছে ৷ এই কাজে মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং কিছু যন্ত্রও দেওয়া হয়েছে ৷ যদিও তার সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা ৷ এখনও প্রচুর মহিলা অসংগঠিতভাবে আমসত্ত্ব তৈরির কাজ করে থাকেন ৷ কোতোয়ালি এলাকার বাসিন্দা যোগমায়া দাস একটি স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর সদস্য ৷ তিনি বলছেন, "একাধারে ফলন ও আবহাওয়ার উপর আমাদের এই কাজ নির্ভরশীল ৷ আমসত্ত্ব তৈরি করতে দিনভর কড়া রোদের প্রয়োজন ৷ এবার যশের ধাক্কায় আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে ৷ এখন আমের দাম চলছে 1200 টাকা মণ ৷ এক মণ আম থেকে আড়াই কিলো আমসত্ত্ব পাওয়া যায় ৷ তাই অন্তত দেড় থেকে দু’হাজার টাকা কিলো দরে বিক্রি করতে না পারলে আমাদের ক্ষতি ৷ সরকারিভাবে আমাদের আমসত্ত্ব তৈরি করার জন্য যন্ত্র দেওয়া হয়েছে ৷ কিন্তু যন্ত্রে তৈরি আমসত্ত্বের মান ভাল হয় না ৷ উৎপাদনও কম হয় ৷ তাই আমরা প্রাচীন পদ্ধতি অনুযায়ীই আমসত্ত্ব তৈরি করি ৷"
এলাকার বাসিন্দা 80 বছরের বৃদ্ধা লক্ষ্মী দাস ৷ দীর্ঘদিন ধরে আমসত্ত্ব তৈরির কাজ শিখিয়ে আসছেন ৷ তিনি বললেন, "গোপালভোগ আম থেকে সবচেয়ে ভাল আমসত্ত্ব তৈরি হয় ৷ কিন্তু এই কাজে প্রচুর পরিশ্রম ৷ সেই অনুযায়ী দাম পাই না ৷ আমরা ঋণ নিয়েই এই কাজ করি ৷ সরকারের তরফে কোনও সাহায্য পাই না ৷ সরকারি সহায়তা পেলে আমরা আরও বেশি আমসত্ত্ব উৎপাদন করতে পারব ৷"
আরও পড়ুন : Noorjahan Mango : সাড়ে 3 কেজি ওজন, একটি আমের দাম 1 হাজার
মালদার আম নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন কমলকৃষ্ণ দাস ৷ তিনি বলছেন, "সরকার যদি আমসত্ত্বের বিপণন ব্যবস্থা ঠিকমতো করে, তাহলে মালদার গ্রামীণ মহিলাদের সঙ্গে জেলার অর্থনীতি আরও মজবুত হবে ৷ রাজ্যের রাজস্বও বাড়বে ৷ তেমন হলে এই জেলা থেকে বছরে 100 কোটি টাকার আমসত্ত্বের ব্যবসা হতে পারে ৷" জেলার বণিকসভা, মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক জয়ন্ত কুণ্ডুর কথায়, "আমসত্ত্ব বাজারজাত করার বিষয়ে আমরা কোনও সরকারি সহায়তা পাই না ৷ মূলত গ্রামের মহিলারাই আমসত্ত্ব তৈরি করেন ৷ গত বছর লকডাউন সহ বিভিন্ন কারণে জেলায় আমসত্ত্ব তৈরি করা যায়নি ৷ এবার জেলায় আমের ভাল উৎপাদন হয়েছে ৷ এই শিল্পে যুক্ত গ্রামীণ মহিলাদের সবাইকে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর আওতায় এনে উৎপাদিত আমসত্ত্ব সরকার বাজারজাত করার ব্যবস্থা করলে গ্রামীণ মহিলাদের পাশাপাশি জেলা ও রাজ্যের অর্থনীতিও উন্নত হবে ৷ জেলার আম বাইরে পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার নানা ব্যবস্থা নিলেও আমসত্ত্বের কথা ভাবা হয়নি ৷"
মালদা ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি উজ্জ্বল সাহার ধারণা মালদার আমসত্ত্ব বিদেশেও পাঠানো যেতে পারে ৷ এর জন্য আমসত্ত্ব নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে ৷ মালদায় কেন্দ্রীয় সরকারের আম গবেষণা সংস্থা রয়েছে ৷ কিন্তু তারা আমসত্ত্ব নিয়ে কিছু ভাবেনি ৷ এ-নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে ম্যাঙ্গো মার্চেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন ৷ তাঁর মতে, রাজ্য ও কেন্দ্রের যৌথ সহযোগিতাতেই মালদার আমসত্ত্ব বিশ্ব বাজারে জায়গা করে নিতে পারে ৷
এনিয়ে কী ভাবছে প্রশাসন ? জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর কৃষ্ণেন্দু নন্দন বলেন, এখানকার তৈরি আমসত্ত্বের গুণগত মান যেরকম তা বিদেশ পাঠানোর উপযুক্ত নয় ৷ যে পদ্ধতিতে এখানে আমসত্ত্ব তৈরি হয় তা স্বাস্থ্যকর নয় ৷ তবে জেলার আমসত্ত্ব বাজারজাত করার জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করছি ৷ তবে এর জন্য প্যাকেজিং ভাল হওয়াটাও জরুরি ৷"
তাঁর কথায়, "পুরোনো রীতিতে তৈরি আমসত্ত্ব রফতানির ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে ৷ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধুলোবালি ও জীবাণুমুক্ত আমসত্ত্ব তৈরি করলে তবেই তা বিদেশে পাঠানো যেতে পারে ৷ আসলে বাইরের মানুষ আমসত্ত্ব চেনে না বলেই এতদিন এর বাজার তৈরি হয়নি ৷ আমসত্ত্বের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে ৷"