মালদা, 22 মে : শুরু হয়ে গিয়েছে রমজান মাস ৷ এই এক মাস ধরে রোজা পালন করেন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা ৷ সারাদিনের উপবাস ভেঙে তারা মিষ্টিমুখ করেন লাচ্ছা ও সিমুই দিয়ে ৷ ফলে এই সময় শুধু মালদা জেলা নয়, গোটা দেশেই লাচ্ছা আর সিমুইয়ের চাহিদা থাকে তুঙ্গে ৷ এই একমাসের ব্যবসার জন্যই রাতারাতি গজিয়ে ওঠে কারখানা ৷ মূলত বিহার ও উত্তরপ্রদেশের কারিগররা যোগ দেন লাচ্ছা-সিমুই তৈরির কাজে ৷ কারখানায় তৈরি লাচ্ছা শুধু জেলায় সীমাবদ্ধ থাকেনা, পৌছে যায় অন্যান্য জেলাগুলিতেও ৷
মালদা জেলায় মাত্র 28 দিনেই প্রায় 8 কোটি টাকার ব্যবসা হয় লাচ্ছা-সিমুই বিক্রি করে৷ কালিয়াচকের চৌরঙ্গি, গয়েশবাড়ি, সুজাপুর সহ কয়েকটি এলাকায় প্রতি বছর ইদের সময় লাচ্ছা ও সিমুই তৈরির ধুম পড়ে যায় ৷ শুধুমাত্র চৌরঙ্গি এলাকাতেই 4-5টি অস্থায়ী কারখানা তৈরি হয়৷ চৌরঙ্গি মোড়ের দু’পাশে প্রচুর অস্থায়ী দোকানও বসে৷ বিভিন্ন মান ও দামের লাচ্ছা ও সিমুই কিনতে ভিড় করে মানুষজন৷ কিন্তু এইবছর লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় সেই ব্যবসাও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৷ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কমপক্ষে হাজার তিনেক মানুষ ৷
লকডাউনের ফলে গোটা জেলায় একটি কারখানাতেও কাজ শুরু করা যায়নি ৷ কিছু ব্যবসায়ী বাড়িতে লাচ্ছা ও সিমুই তৈরি করলেও তা উন্নতমানের নয় ৷ এইবছর রমজান মাসে চৌরঙ্গি মোড়ে দু’তিনটি অস্থায়ী দোকান বসেছে বটে, কিন্তু সেখানে ক্রেতা নেই বললেই চলে ৷ পাইকারি ও খুচরো ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, এবারের রমজানের ব্যবসা পুরোপুরি জলে চলে গেল৷
কালিয়াচকের ঘরিয়ালিচকের বাসিন্দা মহম্মদ হায়দার আলি লাচ্ছার পাইকারি ব্যবসায়ী ৷ তাঁর নিজস্ব কারখানাও রয়েছে ৷ তিনি বলেন, “কোরোনার জন্য এবারের ব্যবসা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল৷ আমরা ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়েছি৷ সারা বছর আমরা রমজান মাসের আশায় বসে থাকি৷ প্রায় এক কোটি টাকার উপর আমার ব্যবসা হয়৷ শুধু মালদা নয়, বিভিন্ন জেলায় আমার কারখানা থেকে লাচ্ছা আর সিমুই পাঠানো হয় ৷ বিহারের ভাগলপুর থেকে আমার কারখানায় কাজ করতে আসে কারিগররা ৷ কিন্তু লকডাউনের জন্য এবার কারিগররা আসতে পারেনি ৷ উৎপাদন না হওয়ায় পণ্য বাইরে পাঠানোর প্রশ্নই আসে না তাই ৷ এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে বাড়িতেই সামান্য লাচ্ছা তৈরি করছি ৷ স্থানীয় কয়েকজন সেই লাচ্ছা আর সিমুই বিক্রি করছেন ৷ তবে তা অত্যন্ত নগণ্য ৷ সময়ও নেই আর ৷ এবার আমাদের ব্যবসার সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়ে গিয়েছে ৷”
শুনশান চৌরঙ্গি মোড়ে সামান্য কিছু লাচ্ছা ও সিমুইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন থানাপাড়ার বাসিন্দা সায়েদ আলি ৷ তিনি বলেন, “এবারের ইদের ব্যবসা একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ কোরোনার ভয়ে মানুষ রাস্তাতেই বেরোচ্ছে না ৷ অন্যান্য বছরে প্রতিদিন গড়ে 10 হাজার টাকার ব্যবসা হয় ৷ এখন দিনে 500 টাকার ব্যবসাও হচ্ছে না৷ সংসার চালাতে তবুও রোজ সামান্য কিছু মাল নিয়ে রাস্তার ধারে বসছি ৷ 100-150 টাকার ব্যবসা হলেও এই মুহূর্তে তা কাজে আসছে ৷ শুনছি, লকাডাউন আরও অনেকদিন চলবে ৷ দোকানপাট সব বন্ধ থাকবে ৷ এবার কোরোনাই আমাদের পথে বসিয়ে দিল ৷”
এক ক্রেতা আশিক শেখ বলেন, “এবার লাচ্ছা-সিমুইয়ের দোকান ঠিকমতো বসছেই না ৷ আগে প্রতিটি দোকানে 4-5 ধরনের লাচ্ছা ও সিমুই পাওয়া যেত ৷ এবার কেবল একধরনেরই সিমুই পাওয়া যাচ্ছে ৷ গোটা কালিয়াচকে মাত্র 4-5 জায়গায় সামান্য কিছু লাচ্ছা পাওয়া যাচ্ছে ৷ লকডাউনের ফলে এবার কারখানাগুলিও চালু হয়নি ৷ উৎপাদন কম থাকায় দামও এবার বেশি ৷ গত বছর যে লাচ্ছা 60 টাকায় কিনেছি, এবার তার দাম 100 টাকা ৷ রমজান মাসে এটাই আমাদের মূল খাবার ৷ কোরোনা এবার তাতেও প্রভাব ফেলেছে ৷”
মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অব কমার্সের সম্পাদক জয়ন্ত কুণ্ডু বলেন, “এই ব্যবসায়ীরা সরাসরি আমাদের সংগঠনের তালিকাভূক্ত নয়৷ তবে ইদের মরশুমে মালদা জেলায় প্রায় 7-8 কোটি টাকার সিমুই ও লাচ্ছার ব্যবসা হয় ৷ জেলার 15টি ব্লকের পাশাপাশি এখানে উৎপাদিত লাচ্ছা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয় ৷ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় হাজার তিনেক মানুষ ৷ এবার কোরোনার জন্য অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে এই ব্যবসাও মার খেয়েছে৷ এতে নিশ্চিতভাবে সমস্যায় পড়তে চলেছে লাচ্ছা ও সিমুই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ৷”