মালদা, 5 জুলাই : “দেশ ছাইড়া পালাবি ইঁদুর / খাইয়া পিটন হুড়কা / যখন মেয়েরা ঘরে ঘরে / ধরবে হাতে চরকা…”
ইংরেজদের দেশছাড়া করতে একসময় এই গান গেয়েছিলেন মালদার গম্ভীরা শিল্পীরা । পদ রচনা করেছিলেন তৎকালীন জেলার প্রখ্যাত গম্ভীরা শিল্পী সুফি মাস্টার । এমন সব গানের জন্য গম্ভীরা শিল্পীদের উপর চাবুক হেনেছিল ব্রিটিশ শাসকরা । কিন্তু তাতেও দমানো যায়নি কয়েকশো বছরের প্রাচীন মালদার এই লোক সংস্কৃতিকে । আন্দোলনের ঢেউয়ে ১৯৪৭ সালে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় ইংরেজ । গম্ভীরা থেকে যায় তার নিজের জায়গাতেই । পরবর্তীতে জেলার প্রখ্যাত গম্ভীরা শিল্পী যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরী জেলার এই লোকশিল্পকে পৌঁছে দেন বিদেশের দরবারে । অবশ্য মালদার মানুষ যোগেন্দ্রনাথ বলে তাঁকে চিনতেন না, জেলার মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন মটরা নামে ।
গম্ভীরার প্রাচীনত্ব কতটা, তার প্রমাণ মিলেছে শিব পুরাণে । গম্ভীরা আদপে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম একটি শাখা । এর মূল ধারাটি আচারগত । গম্ভীরা শব্দটির উৎস ‘গম্ভীর’ অর্থাৎ শিব ৷ গম্ভীরা প্রকৃত অর্থে শিবের উপাসনা ৷ এই ধারাটি হাজারের বেশি বছরের প্রাচীন । তুলনায় এর ব্যবহারিক দিকটি অনেক নবীন । গবেষকদের মতে, এখন যে আকৃতিতে গম্ভীরা মানুষের সামনে প্রদর্শিত হচ্ছে, তার উৎপত্তি মাত্র 500 বছরের কিছু বেশি । গম্ভীরা গানের বৈশিষ্ট্য, সারা বছরের সমাজব্যবস্থাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা । মূলত শাসকের শাসনব্যবস্থায় ভুলত্রুটিগুলিই এই গানের মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরা হয় । এই আসরে শিবের একটি বড় ভূমিকা থাকে । তিনি নানা । অর্থাৎ তিনি সমাজের শীর্ষ অবস্থানের প্রতীক । গম্ভীরা শিল্পীরা স্থানীয় ভাষায় গানের মাধ্যমে শাসকদের নানাবিধ সিদ্ধান্ত নানা অর্থাৎ শিবের সামনে উপস্থাপন করেন । আসরে ভিড় করে থাকা মানুষও সেকথা শোনেন ।
এভাবেই মালদা জেলার সবচেয়ে প্রাচীন লোক সংস্কৃতি মানুষের মনে শিকড় গেড়েছে । কিন্তু করোনা সেই ঐতিহ্যের শিকড়টাই যেন উপড়ে দিচ্ছে । এমনিতেই বিজ্ঞানের দূরন্ত গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োতে নাভিশ্বাস উঠছে এই সংস্কৃতির । তবু জেলার 18টি গম্ভীরা দল এখনও সুপ্রাচীন এই লোক সংস্কৃতির সুতোটা কোনওরকমে ধরে রেখেছে । কিন্তু করোনার জেরে প্রতিটি দলেরই অবস্থা বেহাল । পেট চালাতে পেশা বদলে ফেলছেন শিল্পীরা । এমন অবস্থায় 65 বছরের বৃদ্ধ শিল্পীও এখন শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন । এই পরিস্থিতিতে এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারত সরকারি সহায়তা । দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সহায়তা এখনও অমিল ।
1941 সালে মালদা শহরের কুতুবপুরের গম্ভীরা শিল্পী গোবিন্দ শেঠ ও গোপীনাথ শেঠ । তাঁদের অবর্তমানে গত 32 বছর ধরে কুতুবপুর গম্ভীরা দলের হাল ধরে রেখেছেন তাঁদের উত্তরসুরী প্রশান্ত শেঠ । সেই দলেরই এক সদস্য গোপাল হালদার । বয়স 65 বছর । পুরাতন মালদার সাহাপুর বিমল দাস কলোনির গোপালবাবু বলছেন, “2004 সাল থেকে এই দলের সঙ্গে জড়িত । আমরা গম্ভীরা গান করেই খাই । লকডাউন যেদিন থেকে শুরু হয়েছে, আমাদের গান বন্ধ হয়ে গিয়েছে । আগে গান গাওয়ার পাশাপাশি অনুষ্ঠান বাড়িতে রাঁধুনি ঠাকুরের সহযোগী হিসাবে কাজ করতাম । এখন সেখানেও কাজ জোটে না । 50 জনের বেশি মানুষকে অনুষ্ঠান বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো হয় না । তাই পেট চালাতে এখন ঘরামির কাজ করি । কখনও কখনও রাজমিস্ত্রির সহায়ক হিসাবেও কাজ করতে হয় । মাসে হাজার টাকা সরকারি ভাতা পাই বটে, কিন্তু তাও নিয়মিত পাই না । সরকারের কাছে আমরা শুধু চাই, আমাদের গান ফিরিয়ে দেওয়া হোক । তাতেই আমরা বেঁচে থাকতে পারব ।”
ওই দলেই ট্রামপেট বাজান মালদা শহরের বালুচরের বাসিন্দা পচা বিশ্বাস । তাঁরও বয়স 60 পেরিয়েছে । একসময় যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছিলেন । চিকিৎসকরা তাঁকে ভারি কাজ করতে বারণ করেছেন । কিন্তু করোনা তাঁকে এখন রিকশাচালক হতে বাধ্য করেছে । তিনি বলেন, “2000 সাল থেকে গম্ভীরা দলের সঙ্গে যুক্ত । বাঁশি বাজাই । এই কাজ ছাড়া আর কিছু পারি না । দু’বছর আগেও গম্ভীরার আসর থেকেই পেট চলত । কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে গানবাজনা উঠে গিয়েছে । পেট চালাতে এখন রিকশা চালাই । তাতেও ভাড়া হয় না । দিনে 50-100 টাকা আয় হয় । তাতেই ছ’জনের পেট চলে । একজন শিল্পী হয়ে রিকশা চালাতে মন চায় না । লোকেও খারাপ বলে । কিন্তু পেট তো চালাতে হবে ! এখন সরকার যদি আমাদের একটু কাজকর্ম দেয়, তবে আমরা একটু ভালভাবে চলতে পারব ।”
এই মুহূর্তে মালদা জেলায় গম্ভীরা শিল্পী হিসাবে যথেষ্ট নামডাক রয়েছে অদ্বৈত বিশ্বাসের । তাঁর কথায়, “এই পরিস্থিতিতে এই লোক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে । শিল্পীরা এখন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন । পেট চালাতে তাঁরা পেশা বদল করছেন । হারমোনিয়াম, ডুগি-তবলা সব বেঁধে রেখে দিতে হয়েছে । বাদ্যযন্ত্রে মরচে পড়ছে । এসব খারাপ হলে কীভাবে সারাব, সেটাও ভাবতে হচ্ছে । এখন করোনা বিধিনিষেধ অনেকটা শিথিল হয়েছে । সবই মোটামুটি খুলছে । শুধু খুলছে না সংস্কৃতি । গানবাজনা পুরোপুরি বন্ধ । জমায়েত ছাড়া আমাদের আসর হয় না । এখন জমায়েত সম্পূর্ণ বন্ধ । সরকার মাসে হাজার টাকা ভাতা দেয় । কিন্তু কেউ বলতে পারবেন না, মাসের টাকা মাসে পাচ্ছেন । শুধুমাত্র সরকার দেখলেই কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে । আমরা জেলাশাসককে জানিয়েছিলাম, কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকারি বিজ্ঞাপনে ফ্লেক্স-ফেস্টুন ব্যবহার না করে আমাদের দিয়ে সেই প্রচার করানো হোক । তাহলে সেই প্রচার আমরা অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব । কিন্তু প্রশাসন আমাদের আবেদনে সাড়া দেয়নি ।”
কুতুবপুর গম্ভীরা দলের পরিচালক ও গীতিকার প্রশান্ত শেঠের বক্তব্য, “মালদার গম্ভীরা শিল্প কখনও এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েনি। পেট চালাতে এখন অনেকেই পেশা বদল করছেন। এর আগে আমরা নিজেদের সংগঠনের তরফে জেলা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম, আমাদের মাসে অন্তত পাঁচটি অনুষ্ঠান দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা বছরে একটি সরকারি অনুষ্ঠানেও ডাক পাচ্ছি না। এর সঙ্গে আমাদের মাসিক ভাতার পরিমাণও বাড়াতে হবে। কিন্তু সরকার আমাদের দাবিতে এখনও কোনও কর্ণপাত করেনি। তার উপর সরকার আমাদের গানের বিষয় বেঁধে দিচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কথাই গানে উত্থাপন করতে বলা হচ্ছে। এতে কিন্তু কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই গম্ভীরা তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। কারণ, প্রথম থেকেই গম্ভীরা হচ্ছে প্রতিবাদী মাধ্যম। ব্রিটিশ আমলেও এই সংস্কৃতি তার ঐতিহ্য হারায়নি। তার জন্য গম্ভীরা শিল্পীরা আক্রান্তও হয়েছিলেন। এই লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে শিল্পীদেরও ভূমিকা নিতে হবে। যা ঘটছে তা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাতে দুর্নীতি কিংবা নেতা-মন্ত্রীদের কেচ্ছাও থাকতে পারে। কোভিড পরিস্থিতিতে আমরা সামাজিক প্ল্যাটফর্মে গানের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করেছি। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে এই সংস্কৃতি এখন কিন্তু সংকটের মুখে। শুধু গম্ভীরা নয়, আলকাপ কিংবা খন পালাগানের মতো লোক সংস্কৃতির ভবিষ্যতও এখন সংকটের মুখে।”
দু’বছর ধরে আসরে নয়, আখড়াতেই বেঁচে রয়েছে মালদার গম্ভীরা । অনুশীলনে শিল্পীরা করোনা নিয়ে বাঁধা গানের চর্চায় ব্যস্ত । গানে উঠে আসছে, “বলি নানা/মানুষ চরম যন্ত্রণায় নানা/কোভিডের খাঁড়ায়, প্যাটের জ্বালায়, সাধারণ মানুষ নিরুপায়/করোনায় কপাল মন্দ/কলকারখানা বন্ধ/দিকে দিকে কর্মী ছাঁটাই/নতুন কোনও নিয়োগ নাই/গানবাজনা, খোল করোনা/এখন আমি অন্য পেশায়…”