মালদা, 10 নভেম্বর : কেউ বলে 200, কেউ বা 300 । সঠিক সময়টা কেউই জানে না । সবাই জানে, পুরাতন মালদার সাহাপুরে আমবাগানের মধ্যে রয়েছেন ঝাপড়িকালী । দেবী নাকি খুবই জাগ্রত । আগে নরবলি হত । এখন বলি হয় কি না কেউ জানে না । তবে সেবাইতরা বলছেন, এখনও বলি হয় । নিভৃতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে । ঠিক যেমনটা হত মাখন ডাকাতের আমলে ৷ মাখন ডাকাতের দলে ছিল বিভিন্ন ধর্মের ডাকাত ৷ সেই ডাকাতরা নীরবে মায়ের পুজো করত ৷ এখনও সেভাবেই মায়ের পুজো হয় । সর্বধর্ম সমন্বয়ের পুজো ৷ এখানে দেবীর কোনও মূর্তি নেই । বছরের পর বছর পুজো চললেও এখনও গড়ে ওঠেনি কোনও মন্দির । পুজো ঘিরে এই অন্তরালই ঝাপড়িকালীকে ঘিরে রেখেছে রহস্যের জালে ।
সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সেতু মোড় এলাকা পেরিয়ে বুলবুলচণ্ডীর দিকে যেতে রাস্তার দু'পাশে আমবাগান । বাম দিকে আমবাগানের ভিতর ঢুকে খানিকটা যেতেই দেখা যাবে প্রাচীন একটি শিমূল গাছের নীচে বাঁধানো বেদি । বেদিতে রয়েছে কালীর থান । বেদি থেকে মাত্র দেড়'শ মিটার দূরে বয়ে যাচ্ছে মহানন্দা । জেলার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, কোনও এক সময় এই এলাকায় রাজত্ব চলত মাখন ডাকাতের । তখন এখানে কোনও আমবাগান কিংবা জনবসতি ছিল না । গোটা এলাকা ছিল জঙ্গলে মোড়া । রাত হলে এলাকার দখল নিত হিংস্র শ্বাপদের দল । মাখনের দলে শতাধিক ডাকাত ছিল । বিভিন্ন ধর্মের, জাতের । এলাকা শুধু নয়, এলাকার বাইরেও তারা দলবল-সহ ডাকাতি করতে যেত । কখনও জঙ্গলপথে, কখনও নদীপথে । বাংলাদেশ পর্যন্ত ছিল তাদের অবাধ গতিবিধি ।
কথিত আছে, বড় কোনও ডাকাতি করার আগে মাখন দলবল নিয়ে কালীপুজো করত । ডাকাতি সেরে ফিরে আসার পর ফের সবাই বসত মায়ের আরাধনায় । পুরোটাই হত লোকচক্ষুর অন্তরালে । পুজোর বিষয়টি যাতে নবাবের লোকজন না জানতে পারে তার জন্য তারা কখনও মূর্তি কিংবা হোমের আয়োজন করত না । তা ছাড়া দলে থাকা মুসলমানরা মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসীও ছিল না । সব চিন্তাভাবনা করে ডাকাত সর্দার মূর্তি ছাড়াই মায়ের আরাধনা করত । সেই রীতি এখনও চলে আসছে । কবে থেকে জানা নেই ৷ তবে বংশানুক্রমিক তাঁরা ঝাপড়িকালীর পুজো করে আসছেন ৷ এমনটাই জানালেন সাহাপুর দোলমঞ্চ পাড়ার বাসিন্দা কৃষ্ণকমল চক্রবর্তী । তিনি বলেন, "মাখন ডাকাতই এই কালীপুজোর প্রতিষ্ঠাতা । ডাকাতি করতে যাওয়ার সময় ও ফিরে আসার পর সে দলবল নিয়ে ঝাপড়িমায়ের আরাধনা করত । তবে প্রথম থেকেই এখানে ঘটপুজো হয় । ঝোপঝাড়ের মধ্যে থাকার জন্য এর নাম ঝাপড়িকালী । যেখানে ঝাপড়িকালীর বেদি রয়েছে, তার অদূরেই রয়েছে রাস্তা । এখন সেখান দিয়েই মালদা-বুলবুলচণ্ডী রাজ্য সড়ক তৈরি হয়েছে । এই রাস্তাও অতি প্রাচীন । সম্ভবত রাস্তার কাছে বেদির অবস্থান হওয়ায় এখানে কখনও মূর্তিপুজোর প্রচলন করেনি ডাকাতরা । একসময় এখানে বলিপ্রথা ছিল । শোনা যায়, ডাকাতরা এখানে নরবলিও দিত । এখনও বলি দেওয়া হয় । তবে সেই বলি কাউকে দেখতে দেওয়া হয় না । "
এই কালী নিয়ে এখনও যে স্থানীয় বাসিন্দারা রহস্যের গন্ধ খোঁজে, তার প্রমাণ মিলেছে এলাকাবাসীর কথায় । স্থানীয় এক বাসিন্দা কালীচরণ চৌধুরি বলছেন, " প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বেদিতে মায়ের পুজো হয় । তবে কালীপুজোর দিন ঠিক কেমন পুজো হয় তা জানতে পারিনি কখনও । রাত দশটা পর্যন্ত মানুষ এখানে আসে । তারপর আর কেউ থাকে না । মা খুব জাগ্রত । মায়ের কাছে মানত করে অনেকেরই ইচ্ছাপূরণ হয়েছে । তাই প্রতিবছর কালীপুজোর দিন এলাকার মানুষের সঙ্গে অনেকে মানত পূরণের পুজো দিতে আসে । এভাবেই দু'শো বছরের বেশি সময় ধরে এখানে পুজো হয়ে আসছে । তবে এখানে মায়ের কোনও মূর্তি ওঠে না । কেন, তা জানি না । হয়তো এলাকার বয়স্ক মানুষজন সে কথা বলতে পারবে । "
স্থানীয় আর এক বাসিন্দা রতন হালদার বলেন, "ছোটো থেকেই এই পুজো দেখছি । এই পুজোর বয়স দু'শো, কিংবা তিনশোও হতে পারে । আমরা শুনেছি, ডাকাতরা এখানে এই পুজো করত । পরে আমবাগান তৈরির পর মানুষ এখানে যাওয়া-আসা শুরু করে । আগে এখানে গৌড়ীয় ইটের একটি বেদি ছিল । 10-12 বছর আগে তার উপর নতুন বেদি তৈরি করা হয় । আগে তো এখানে প্রচুর জঙ্গল ছিল । শিয়ালের দল দিনদুপুরে চরে বেড়াত । এখন সেই জঙ্গল নেই, শিয়ালের পালও নেই । তাই মানুষের ভয় কমেছে । কালীপুজোর সন্ধে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত লোকজন এখানে আসে । প্রসাদ দিয়ে চলে যায় । এই পুজোয় বলি আমি কোনওদিন হতে দেখিনি । হয় কি না তাও জানি না । এখানে প্রতিমাও কখনও ওঠে না । কেন, সেটাও জানি না । "