মালদা, 16 জুন : 'চল রে মন, গুপ্ত বৃন্দাবন' ৷ বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী যেকোন মানুষের মুখেই এই বাক্যবন্ধ শোনা যায় ৷ নাম কখনও গুপ্ত বৃন্দাবন, কখনও আবার মাতৃগয়া ৷ ধাম কিন্তু একটাই, রামকেলি ৷ প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি থেকে তিনদিন ধরে উৎসব চলে এই ধামে ৷ বসে বিশাল মেলা ৷ লাখো মানুষের সমাগম ৷ তাই জেলার অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে সেই মেলা ৷ কিন্তু দু’বছর ধরে বাধ সেধেছে করোনা ৷ সংক্রমণের আশঙ্কায় প্রশাসন কোথাও কোনও মেলা করতে দিচ্ছে না ৷ গত বছর পূর্ণাঙ্গ লকডাউনে এই রামকেলিতে কয়েকজন মানুষ কোনওমতে এসেছিলেন শুধু পুজো দিতে ৷ এবার বিধি-নিষেধ কিছুটা শিথিল হওয়ায় কিছু ভক্ত উৎসবে যোগ দিয়েছেন বটে, কিন্তু তা নেহাতই হাতে গোনা ৷ করোনার দাপটে একদিকে যেমন ভক্তরা বঞ্চিত, তেমনই অতিরিক্ত উপার্জন থেকে বঞ্চিত রামকেলি গ্রামের মানুষও ৷
কথিত আছে, নবদ্বীপ থেকে বৃন্দাবনে যাওয়ার পথে 1514 সালের জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির দিন মালদা শহর থেকে মাত্র 14 কিলোমিটার দূরে তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে পদার্পণ করেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ৷ রামকেলি গ্রামে একটি তমাল গাছের নিচে তিনদিন কাটিয়েছিলেন তিনি ৷ তখন সমাজ সংস্কারের স্বপ্নে মজে ধর্মজাগরণে নেমেছেন তিনি ৷ তাঁর নাম ছড়িয়েছে আসমুদ্র হিমাচল ৷ তাই তাঁকে চাক্ষুষ করতে তমালতলায় এসেছিলেন তৎকালীন গৌড়াধিপতি নবাব হুসেন শাহের মন্ত্রিসভার দুই সদস্য দাবির খাস ও সাকর মল্লিক ৷ মহাপ্রভুকে দেখে, তাঁর কথা শুনে তাঁরা দু’জনেই মানবপ্রেমের ধর্মে দীক্ষিত হন ৷ নতুন নাম হয় রূপ ও সনাতন গোস্বামী ৷ তিন দিন পর শ্রীচৈতন্য আবার পদব্রজে রওনা দেন বৃন্দাবন ধামের উদ্দেশ্যে ৷ গৌড় নগরীতে মহাপ্রভুর আগমনকে মনে রেখে প্রতি বছর জৈষ্ঠ্য সংক্রান্তিতে তিন দিনের ধর্মোৎসব চালু করেন নিত্যানন্দ গোস্বামীর উত্তরসূরি গোস্বামী অটলবিহারী দেবানন্দ প্রভুপাদ ৷ এবার সেই উৎসব 507 বছরে পা দিল ৷
রামকেলি কেন গুপ্ত বৃন্দাবন ? সুলতানি আমল ও তার পরবর্তী সময়ে রামকেলি মেলায় অবগুণ্ঠনে থাকা নারীদের শুধুমাত্র কনিষ্ঠ আঙুল দেখে জীবনসঙ্গী নির্বাচিত করতেন বৈষ্ণবরা ৷ সেই সময় বৃন্দাবনে নারীদের মুখ দেখেই জীবনসঙ্গী নির্বাচন করা হত ৷ সেকারণেই রামকেলি বৈষ্ণবদের কাছে গুপ্ত বৃন্দাবন ৷ কিন্তু শুধু গুপ্ত বৃন্দাবন নয়, রামকেলি ধাম বৈষ্ণবদের কাছে মাতৃগয়া নামেও পরিচিত ৷ ভারতবর্ষে একমাত্র এখানেই মেয়েরা প্রয়াত মায়েদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করেন ৷ রামকেলির গয়েশ্বরী মন্দিরে প্রয়াত মায়েদের আত্মার চিরশান্তি কামনা করেন মেয়েরা ৷ মন্দির কমিটির সদস্য সীতারাম মণ্ডল জানালেন, "কথিত আছে, অতি প্রাচীনকালে বনবাসে থাকাকালীন সীতাদেবী তাঁর প্রয়াত মায়ের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করেছিলেন ৷ তিনি গৌড়ের কোনও জায়গায় পিণ্ডদান করেছিলেন ৷ তারপর থেকেই রামকেলিতে এই প্রথা চালু রয়েছে ৷ তাই এর আরেক নাম মাতৃগয়া ৷ বিদেশ থেকেও অনেক মহিলা এখানে প্রয়াত মায়েদের নামে পিণ্ডদান করতে আসেন ৷ তবে করোনার জন্য দু’বছর ধরে এখানে লোকজন নেই ৷"
আরও পড়ুন : এখনও মেলেনি ভাতা, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি শুধুই নির্বাচনী চমক; অভিযোগ মালদার পুরোহিতদের
করোনার বিধির কারণে এখনও পরিবহণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি ৷ তার মধ্যেও কোনওরকমে রামকেলি এসে পৌঁছেছেন রায়গঞ্জের বিমল ঘোষ ৷ প্রৌঢ়ের বক্তব্য, "দীর্ঘদিন ধরে প্রতি বছর এখানে আসি ৷ প্রথমে পাঁচ টাকা খরচ করেই চলে আসতাম ৷ এবার তিনদিন আগেই এসেছি ৷ মহাপ্রভুর মন্দিরে ঘুমোই ৷ গৌড়ের টানেই চলে আসি বারবার ৷ এখানে না এলে থাকতে পারি না ৷ আর করোনা ! গৌড়ই করোনা ভাল করে দেবে ৷" তবে মেলা না বসায় কিছুটা মন খারাপ বিমলবাবুর ৷ মন খারাপ বৈষ্ণবনগর থেকে স্বামীর মোটরবাইকে আসা ডলি সরকারেরও ৷ তবে পুজোটা যে দিতে পেরেছেন সেটাই শান্তি বলে জানান ডলি ৷
আরও পড়ুন : দিল্লিগামী নতুন সুপারফাস্ট ট্রেন চালু মালদায়
এসবের পাশাপাশি রামকেলি মেলা ওই গ্রামের বাসিন্দাদের অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের একটা ক্ষেত্রও বটে ৷ মেলার ক’দিন আগে থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পসারিরা স্থানীয়দের ঘর, এমনকি বারান্দাও ভাড়া নেন ৷ এলাকার অনেকেই মেলায় দোকান দেন ৷ লক্ষ মানুষের সমাগমে ব্যবসা জমে ওঠে ৷ মেলায় কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হত ৷ কিন্তু দু’বছর ধরে সেসবের নামগন্ধ নেই ৷ স্থানীয় পপি রবিদাস বলেন, "ঠিকভাবে মেলা লাগলে সবাইকে জায়গা দেওয়া যায় না ৷ আমাদের ঘর, বারান্দা, সব ভাড়া হয়ে যেত ৷ কিন্তু করোনার জন্য দু’বছর ধরে আমাদের রোজগার নেই ৷ এবার বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া উচিত ৷ এবার কিছু লোকজন এসেছে ৷ পুজো দিয়ে চলে যাচ্ছে ৷ আমরা চাই, আগামী বছর আবার মেলা বসুক ৷"
একই কথা স্থানীয় প্রিয়া মণ্ডলেরও ৷ তিনি বলে, "করোনা সব কেড়ে নিয়েছে ৷ দু’বছর ধরে কিছুই হচ্ছে না ৷ আমরা এই রামকেলি উৎসব কখনও দেখিনি ৷ এবার আমরাও পুজো দিয়েই বাড়ি চলে যাচ্ছি ৷" করোনার জেরে দু’বছর ধরে ব্যবসা জমছে না বাতাসা-নকুলদানা বিক্রেতা পিন্টু দাসেরও ৷ তিনিও চাইছেন, করোনার ঝামেলা দ্রুত মিটুক ৷ রামকেলি মেলা আবার প্রাণ ফিরে পাক ৷
অর্থাৎ রামকেলি মেলায় একদিকে যেমন মিশে রয়েছে 500 বছরের প্রাচীন ইতিহাস, তেমনই মিশে রয়েছে ধর্ম, মিশে রয়েছে অর্থনীতিও ৷ করোনা থাবা বসিয়েছে তিন ক্ষেত্রেই ৷
আরও পড়ুন : Covid-19 : বরাদ্দ মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমিক, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্ষতির মুখে বাংলার চা শিল্প