মালদা, 29 জুন: ঈদের আনন্দ বদলে গেল আতঙ্কে ৷ বৃহস্পতিবার ঈদ আল-আদহা উৎসবে তাই গ্রামের কারও গায়ে ওঠেনি নতুন জামা ৷ কংগ্রেস-তৃণমূলের নির্বাচনি সংঘর্ষে বুধবার রাত থেকেই উত্তপ্ত ইংরেজবাজারের ফুলবাড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের নতুন নঘরিয়া গ্রাম ৷ বৃহস্পতিবারও থমথমে রয়েছে গোটা গ্রাম ৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বুধবার রাত থেকেই গ্রামে রয়েছে পুলিশ পিকেটিং ৷ এদিন রুটমার্চ করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনীও ৷ অভিযোগ, ঈদের আগের রাতে মুহুর্মুহু বোমার শব্দে বারবার কেঁপে উঠেছে গ্রাম ৷ আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে দু'টি বাড়িতে ৷ ভাঙচুর করা হয় অন্তত পাঁচটি বাড়ি ৷ এই ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বেরও অভিযোগ উঠেছে ৷
এক ব্যাক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করলেও তৃণমূল নেতা লাকি আলি ও অন্য়ান্যদের তরফে দায়ের করা অভিযোগে কোনও গুরুত্ব দেয়নি পুলিশ ৷ ইংরেজবাজার থানার তরফে ধৃতদের এদিন জেলা আদালতে পেশ করা হয়েছে ৷ তবে গোটা ঘটনার পিছনে উঠে এসেছে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের কাহিনী ৷
ঘটনাস্থল নতুন নঘরিয়া গ্রামের নাদাব পাড়া ৷ এই পাড়ারই বাসিন্দা জাহেদুল শেখ ও লাকি আলি ৷ তাঁরা দু’জনেই এলাকার প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা ৷ জাহেদুল বর্তমানে ফুলবাড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ৷ এবার ওই পঞ্চায়েতের তিন ও চার নম্বর বুথটি মহিলা সংরক্ষিত ৷ এতদিন পঞ্চায়েত সদস্য লাকি আলিই ওই এলাকায় তৃণমূলকে নেতৃত্ব দিতেন ৷ কিন্তু এবার তাঁর স্ত্রী'কে টিকিট দেয়নি শাসকদল ৷ তাই তাঁর স্ত্রী আরশি বিবি এবার কংগ্রেসের টিকিটে চার নম্বর বুথে প্রার্থী হয়েছেন ৷ এই বুথে ঘাসফুলের প্রার্থী জাহেদুলের স্ত্রী রাহেমা বিবি ৷ অন্যদিকে, তিন নম্বর বুথে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন লাকি ঘনিষ্ঠ লুসি বিবি ৷ এই বুথে তৃণমূল প্রার্থী জাহেদুল ঘনিষ্ঠ শাহজাদ নাদাবের স্ত্রী মাম্পি খাতুন ৷ অভিযোগ, তৃণমূলের প্রার্থী ঘোষণার কিছুদিন আগে লাকি ও তাঁর দলবল কংগ্রেসে ভিড়ে যান ৷ তখন থেকেই দুই গোষ্ঠীর সংঘাত শুরু হয় গ্রামে ৷ গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, মনোনয়ন পর্বের আগে থেকেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে চোরাগোপ্তা সংঘর্ষ চলছিল ৷ গতকাল রাতে তা বড় আকার নেয় ৷ খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ইংরেজবাজার থানার পুলিশ ৷
এদিন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, থমথম করছে গোটা এলাকা ৷ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এদিন ঈদ ৷ এখানে ওখানে জটলা ৷ সাংবাদিক দেখে অনেকেই ঘরে ঢুকে পড়ছেন ৷ পরে অবশ্য কেন্দ্রীয় বাহিনী দেখে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ৷ শাহজাদের এক আত্মীয়া ইয়াসমিন খাতুন বলেন, “প্রথমে মারামারি শুরু হয় মামাশ্বশুর শাহজাদের বাড়িতে ৷ তাঁর স্ত্রী মাম্পি খাতুন এবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন ৷ ওদের বাড়ি ভাঙচুর করার পর ওরা আমার দোকানে চলে আসে ৷ সেই খবর পেয়ে আমি ভয়ে শাশুড়ির বাড়ি চলে যাই ৷ ওরা আমার দোকানের জানালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে সব কিছু পুড়িয়ে দিয়েছে ৷ এই ঘটনা ঘটিয়েছে লাকি, বুদ্দিন, আলেমরা ৷ ওরা আবার যে কখন কী করবে, বলতে পারছি না ৷ খুব ভয়ে আছি ৷ রাতে পুলিশই দোকানের গেট খুলে পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র বাইরে বের করে ৷”
এদিকে লাকি আলির তরফে গোলেনুর বিবি বলছেন, “জাহেদুল, শাহজাদরা বলছে, লাকিরা যেহেতু ভোটে দাঁড়িয়েছে তাই ওদের একেবারে শেষ করে দেবে ৷ ওরা সবাই তৃণমূল করে ৷ লাকি তৃণমূলেরই পঞ্চায়েত সদস্য ছিল ৷ এবার ওঁর স্ত্রীকে দল টিকিট না দেওয়ায় ওরা সবাই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে ৷ গতকাল রাতে সব কিছু ঘটেছে জাহেদুলের ইশারায় ৷ টিকিট বিলির সময় থেকেই জাহেদুলরা লাকিকে নিশানা করেছে ৷” গ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে গতকাল থেকেই মোতায়েন রয়েছে পুলিশ ৷ এদিন কেন্দ্রীয় বাহিনীও ওই গ্রামে রুটমার্চ করে ৷ কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাছে এলাকায় শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানাতে দেখা যায় গ্রামের মহিলারা ৷ গ্রামবাসীদের মন থেকে আতঙ্ক দূর করতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা খুদেদের চকোলেটও বিতরণ করেছেন ৷ বিএসএফের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা গুলশন খাতুন বলেন, "বুধবার রাতে জাহেদুলের লোকজন আমার বাড়ি, দোকান ভেঙে দিয়েছে ৷ প্রায় দু’লাখ টাকার মাল আর 38 হাজার টাকা নগদ লুট করেছে ৷ সোনাদানাও নিয়ে গিয়েছে ৷ অথচ পুলিশ শুধু জাহেদুলের কথাই শুনছে ৷ আমরা গতকাল অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ গুরুত্ব দিচ্ছে না ৷ অথচ জাহেদুলের কথায় পুলিশ গ্রামে চলে আসছে ৷ কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সব বললাম ৷ কিন্তু ওরাও চলে গেল ৷”
আরও পড়ুন: ঈশ্বরের কৃপা ও মেডিক্যাল টিমের চেষ্টায় সুস্থ হয়ে উঠছি, সকলকে ধন্যবাদ দিতে টুইট মুখ্যমন্ত্রীর
ঘটনা প্রসঙ্গে, পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব বলেন, “এই ঘটনায় জাহেদুল শেখের তরফে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ৷ তার ভিত্তিতে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলাকায় পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছে ৷” এদিকে ইংরেজবাজার থানা সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃতদের নাম শেখ বাগ্গু, শেখ ওয়াসেদ এবং ওয়াসিম আলি ৷ 10 দিনের পুলিশি হেফাজতের আবেদন জানিয়ে ধৃতদের এদিন মালদা জেলা আদালতে পেশ করা হয়েছে ৷