কলকাতা, 30 ডিসেম্বর: কলকাতার অবস্থা কেমন তা বোঝাতে একসময় একটি ছড়ার প্রচলন ছিল- "রাতে মশা, দিনে মাছি/ এই নিয়ে কলকাতায় আছি।" শহরের সেই অবস্থা আর নেই। মশা-মাছি সব মুলুক ছেড়েছে এমনটা নয় নিশ্চয়। তবে রোগের দাপট কমেছে বলে দাবি করে পৌরনিগম থেকে শুরু করে রাজ্য় প্রশাসন। কিন্তু একটা ব্যাপারে কলার তোলার কোনও সুযোগ বাংলার কেষ্টবিষ্টুদের নেই। সেটা হল সন্ত্রাস। ভোট হোক না হোক বাংলায় রক্ত ঝড়ে, বোমা পড়ে। এটাই যেন দস্তুর ৷ সোশাল মিডিয়ায় দেখা যায় অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের নাম একটু বদলে হাসির ছলে ‘পশ্চিমবমগো’রেখে ফেলেছেন। ব্যাপারটা অত বাড়াবাড়ি পর্যন্ত গিয়েছে কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে ঘটনা থুড়ি দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে বাংলা যে ভারতের অন্য রাজ্যগুলির থেকে এগিয়ে তা নিয়ে তর্ক বা বিতর্কের বিশেষ অবকাশ নেই।
2023 সালেও বাংলায় সন্ত্রাসের ঘটনা থামেনি। পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে শুরু করে পারবারিক বা স্থানীয় হিসাংয় প্রাণ গিয়েছে বহু মানুষের। বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা এই একটা বছরে একবার নয় দু'বার ঘটেছে। এর পাশাপাশি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা এবং তা থেকে সন্ত্রাসের ঘটনাও নতুন নয় আমাদের এই বাংলায় ৷ দুর্ঘটনা পাশপাশি পুরনো কয়েকটি ঘটনায় সাজা ঘোষণাও হয়েছে এবছর ৷ এই প্রতিবেদনে আমরা ফিরে দেখব সেই সমস্ত ঘটনা ৷
পঞ্চায়েত নির্বাচন: বাংলার পঞ্চায়েত ভোট আর সন্ত্রাস একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৷ স্মরণাতীত কালে এমন কোনও নির্বাচন বাংলা দেখেনি যেখানে সন্ত্রাস হয়নি ৷ কমবেশি সন্ত্রাস নিয়েই ভোট পর্ব দেখে আসছে বাংলা ৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনে এর অন্যথা হবে এমন কোনও কথা ছিল না ৷ কার্যক্ষেত্রেও সেটা হয়নি ৷ শুধু ভোটের দিন প্রাণ যায় 12 জনের ৷ আর নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় ধরলে মোট প্রাণ হারান 39 জন ৷ কয়েকশো কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে এসেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি ৷ গ্রাম বাংলার এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্তে সবুজ ঝড় বইলেও সন্ত্রাসের অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি বাংলার শাসক শিবির ৷ বিশেষ করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার তৃণমূলকে সাহায্য করছেন বলে অভিযোগ ওঠে ৷ তাঁর ভূমিকা নিয়ে শুধু বিরোধীরা নয়, প্রশ্ন তোলে আদালতও ৷ এবার আরও একটা মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটে ৷ রাজভবনে শান্তিকক্ষ খোলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস ৷ রাজ্যের প্রায় সমস্ত জেলা থেকেই এখানে ভোটে সন্ত্রাস নিয়ে অভিযোগ দয়ের হয় ৷ পরে রাজ্যপাল নির্দেশ দেন রাজভবনে যত ফোন এসেছে সেগুলিকে কলকতা হাইকোর্টে জমা দিতে হবে ৷ রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের নির্দেশ মতো হাইকোর্টের ভোটে হিংসা সক্রান্ত কমপক্ষে তিন হাজারটি অভিযোগ জমা পড়ে রাজভবনের তরফে ৷
বিয়ের 15 দিনের মাথায় খুন: প্রেম ছিল দু'জনের ৷ দুই বাড়ি প্রথমে রাজি না হলেও পরে মত দেয় ৷ রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয় ৷ তবে হরিদেবপুরের তরুণ-তরুণীর ভাগ্যটা তেমন ভালো ছিল না ৷ তার কারণ অবশ্য তাঁরা নিজেরাই ৷ স্ত্রী কৃষ্ণা দে চেয়েছিলেন সম্পর্ক শেষ করে দিতে ৷ স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে বাপের বাড়ি চলে আসেন স্ত্রী ৷ স্বামী শুভেন্দু দাস রাজি হননি ৷ স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁকে কুপিয়ে খুন করেন স্বামী ৷ পরে বিষ খেয়ে নিজেকেও শেষ করে দেন শুভেন্দু ৷
পুজোর মুখে বাড়ি ঢুকে খুন: উত্তর কলকাতার হেদুঁয়া পার্কের পরিচিতি শান্ত নিরবিলি জায়গায় হিসেবেই ৷ বেশ কিছু পুরনো বাড়ি আজও মাথা তুলে নিজেদের বনেদিয়ানার অস্তিত্ব জানান দেয় সদর্পে ৷ সেখানেই ঘটে যায় ভয়াবহ এক ঘটনা ৷ পুজোর তখন বাকি দিন দশেক ৷ আচমকাই 11 অক্টোবর সন্ধ্যায় বাড়ি ঢুকে মিনাক্ষী ভট্টাচার্যকে খুন করে কয়েকজন ৷ বাধা দিতে গিয়ে ছেলেও আক্রান্ত হন ৷ তবে চিকিৎসকদের চেষ্টায় তাঁর প্রাণ বাঁচে ৷ পাঁচ দশক ধরে পাড়ার পুজোয় সক্রিয় মিনাক্ষীর মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেননি ৷ হত্যার কারণ বুঝতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে ৷ পারিবারিক কোনও শত্রুতা থেকে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা ৷
এগরা থেকে দত্তপুকুর বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ: পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা প্রশাসনকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল সন্দেহ নেই ৷ মে মাসের 16 তারিখ আচমকাই এগরার ওই কারখানা থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় ৷ পরে জানা যায় এই ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে 11 জনের ৷ আরও পরে কারখানার মালিক ভানু বাগকে গ্রেফতার করে সিআইডি ৷ বিস্ফোরণের পরই ওড়িশায় পালিয়ে যায় ভানু ৷ তারও শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গিয়েছিল ৷ চিকিৎসা করতেই ওড়িশা যায় সে ৷ সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করলেও পরে তার মৃত্যু হয় ৷ এই এগরার ঘটনা ঘিরে রাজনৈতিক চাপানউতোরও দেখা দেয় ৷ নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন এগরার ওই এলাকাটিতে বিজেপির শক্তি বেশি ৷ স্থানীয় পঞ্চায়েতের দখলও তাদের ৷ আর তাই বিস্ফোরণের পর সেখানে তৃণমূলের বিধায়ককে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ৷ এই এগরার ঘটনার কিছু দিন পরই দত্তপুরকুরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে ৷ সেখানেও বেশ কয়েকজনের প্রাণ যায় ৷ এই ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর থেকে বিস্ফোরক আনা হয়েছিল বলে জানতে পেরেছিলেন তদন্তকারীরা ৷
নমাজ পড়ে ফেরার পথে গুলিতে খুন শাসক নেতা: নমাজ পড়তে গিয়ে প্রাণ হারান জয়নগরের শাসক নেতা সইফউদ্দিন লস্কর ৷ পরিবার সূত্রে খবর, তিনি রোজই নামাজ পড়তে যেতেন ৷ পুলিশের অনুমান, এই খবর আগে থেকেই জানত আততায়ীরা ৷ ঠিক কোন সময়ে তিনি মসজিদে যেতেন সেটাও জানা ছিল তাদের ৷ আর সেই সুযোগেই তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলা হয় বলে অনুমান পুলিশের ৷
রাজ্যে রাজ্যে খুন বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা: বাংলায় কর্মসংস্থানের অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ সেটা অনুমান করা খুব কঠিন নয় ৷ দেশের প্রায় সব রাজ্যেই বাংলা থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের খোঁজ পাওয়া যায় ৷ তাঁদের মৃত্যুর খবর মেলে হামেশাই ৷ ঘটেছে হত্যার ঘটনাও ৷ গুজরাতে রুপো চুরির অভিযোগে দুই বঙ্গ তনয়কে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে অক্টোবর মাসে ৷ এছাড়া কেরলের ভাড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় মুর্শিদাবাদের যুবক সুব্রত হালদারের দেহ ৷ পরিবারের লোকের দাবি, বাড়িওয়ালার সঙ্গে গোলমালের জেরেই প্রাণ গিয়েছে সুব্রতর ৷ এই কেরলেই বালি চাপা পড়ে প্রাণ যায় পাথরপ্রতিমার এক যুবকের ৷ এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ঘটনায় ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারান বাংলার শ্রমিকরা ৷
আরও পড়ুন: