কলকাতা, 7 মার্চ : কখনও দুর্গা... কখনও কালী... অশুভ বিনাশে বার বার শরণাপন্ন হতে হয়েছে নারীশক্তির কাছে । তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজালটা যেন কোথাও বিলীন হয়ে যায় আধ্যাত্মিকতার দুনিয়ায় । কুমোরটুলির অলিগলি বেয়ে যত এগিয়ে যাবেন, তত চোখে পড়বে নারীশক্তির রূপ । নারীশক্তি এখানে শুধু দেবলোকেই সীমিত নেই । পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিমা বানাচ্ছেন মহিলারাও । চায়না পাল, মালা পাল ও কাকলি পালরা আজ সমান তালে প্রতিমা বানিয়ে যাচ্ছেন কুমোরটুলিতে ।
প্রতিমা তৈরিতে আজ কুমোরটুলির নাম উজ্জ্বল করেছেন এই তিন নারী । একটা সময় ছিল যখন মনে করা হত পুরুষরাই শুধু প্রতিমা তৈরি করতে পারেন । মহিলাদের ধারে কাছে ঘেঁষার সুযোগ দেওয়া হত না । কিন্তু পুরুষপ্রধান মৃৎশিল্পীদের এই সমাজের ধ্যান ধারণাকে পাল্টে দিয়ে এগিয়ে চলেছে মহিলা মৃৎশিল্পীরা। আজ তাঁরা মৃৎশিল্পী হিসেবে যে শুধু নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন তাই নয় , পুরুষদের রীতিমতো টেক্কা দিচ্ছেন প্রতিমা তৈরিতে । চায়না পাল, মালা পাল ও কাকলি পাল আজ কুমোরটুলির উজ্জ্বল নক্ষত্র ।
কলকাতা, রাজ্য, দেশকে গণ্ডি পেরিয়ে চায়নার হাতের প্রতিমা আজ বিদেশের মাটিতেও সমাদৃত । দেশ-বিদেশের একাধিক সম্মানে পুরস্কৃত হয়েছেন চায়না পাল ।
আরও পড়ুন : নারী-পুরুষের সমানাধিকারের পক্ষেই সর্বদা সওয়াল করেছেন গান্ধিজি
ছোটোবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল প্রতিমা তৈরি করার । কিন্তু বাধা ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজাল । বাবার কঠোর নিষেধ ছিল । তবে বাবার চোখের আড়ালে স্টুডিয়োতে গিয়ে ছোটো-খাটো মূর্তি তৈরি করতেন । বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে হয় চায়নাকে । পাকাপাকিভাবে পা রাখলেন স্টুডিয়োতে । শুরু হলো এক নতুন ইতিহাস । অনেক সংগ্রাম করে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা তৈরি করলেন । প্রমাণ করে দিলেন, যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধতে জানেন । আজ চায়না একহাতে সংসার আর এক হাতে প্রতিমা তৈরির কাজ... দু'টোই চালাচ্ছেন সমান তালে ।
চায়নার মতোই ছোটোবেলাটা অনেকটা একইরকমভাবে কাটিয়েছেন মালা । ছোটো থেকেই প্রতিমা তৈরির শখ ছিল । কিন্তু মামার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার সাহস সেদিন দেখাতে পারেননি । পরে ছবি আঁকা শিখতে দিল্লি গিয়েছিলেন । প্রশিক্ষণ নিয়ে কলকাতায় ফিরে দাদার অনুপ্রেরণাতেই মূর্তি গড়ার কাজ শুরু করেন মালা পাল।
সেইসময়েও কুমোরটুলিতে মহিলা মৃৎশিল্পীদের ভালো চোখে দেখা হত না । অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে করতে আজ সফলতা অর্জন করেছেন তিনি । আজ ছোটো প্রতিমার তৈরি জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অর্ডার পান । সন্তান সংসার সবকিছু সামলে নিয়মিত স্টুডিয়োতে এসে প্রতিমা গড়েন নিজের হাতে । আজ নতুন প্রজন্মের মহিলা মৃৎশিল্পীদের অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা মালা । তাঁকে দেখে অনেকে আসছেনও এই কাজে।
আরও পড়ুন : নারী সমানাধিকার দিবস
কুমোরটুলির আর এক পরিচিত নাম কাকলি পাল। স্বামী ও শ্বশুর কুমারটুলি প্রতিমা তৈরি করতেন । কম বয়সে স্বামী মারা যান । দুই সন্তান নিয়ে সংসার কীভাবে সংসার চালাবেন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই শুরু হয় নতুন এক জীবন যুদ্ধের কাহিনি । অনেক পরিশ্রমে প্রতিমা তৈরির কাজ শিখেছেন । আর এখন দাপটের সঙ্গে প্রতিমা তৈরি করে পুরুষ শিল্পীদের রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছেন তিনি । আজ এই সাফল্য কথা ভাবতে ভাবতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন কাকল । দুই মেয়ে বড় হয়েছে । এক মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন । ছোটো মেয়ে এখনও পড়াশোনা করছে । দুই মেয়েই আজ তাঁর গর্ব ।