কলকাতা, 2 সেপ্টেম্বর : নিজের রাজ্যে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছিলেন বিহারের এক যুবতি ৷ বাদ দেওয়া হয় তাঁর জরায়ু ৷ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালেও একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয় একটি ইউরেটার তথা কিডনির নালি । তৈরি হয় প্রাণহানির আশঙ্কা ৷ শেষপর্যন্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের তৎপরতায় জীবন ফিরে পেলেন বছর 27-র সুষমা দেবী ৷
বিহারের ভাগলপুরের বাসিন্দা সুষমা । দুই সন্তান রয়েছে তাঁর ৷ সম্প্রতি ফের অন্ত্বঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তিনি ৷ কিন্তু, কয়েকদিন পর তাঁর যৌনাঙ্গ থেকে শুরু হয় রক্তক্ষরণ । ভরতি করা হয় ভাগলপুরের সদর হাসপাতালে । সেখানে গত বছর সেপ্টেম্বর এবং ডিসেম্বরে দু'দফায় সুষমার অস্ত্রোপচার হয় ৷ বাদ দেওয়া হয় তাঁর জরায়ু ৷ তাতে সমস্যার সুরাহা হয়নি ৷ হতে থাকে রক্তক্ষরণ ৷ এরপর বাধ্য হয়ে সুষমাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় ৷ আনন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভরতি করা হয় । চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেখানে তাঁর অস্ত্রোপচার হয় ৷ কিন্তু, বন্ধ হয়নি রক্তক্ষরণ ৷ 27 ফেব্রুয়ারি তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা ৷ তখন তাঁর অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক ৷ প্রাণ বাঁচানো নিয়ে সংশয়ে ছিলেন চিকিৎসকরা ৷ তবে, হাল ছাড়েননি তাঁরা ৷ শুরু হয় কেমোথেরাপি ৷ বৃহস্পতিবার তা শেষ হয়েছে ৷ পরদিন তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয় ৷ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আপাতত সুস্থ রয়েছেন সুষমা ৷ তবে, ছয় সপ্তাহ পর হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগে ফের তাঁর চিকিৎসা শুরু হবে ।
কিন্তু, ঠিক কী হয়েছিল সুষমার ? মেডিকেল কলেজের স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ তারাশংকর বাগ বলেন, "সুষমার মোলার প্রেগনেন্সি হয়েছিল । কোনও কারণে বিহারে এটা ধরা পড়েনি । এই ধরনের প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হয় । যদি দেখা যায় hCG হরমোনের মাত্রা বাড়ছে, তা হলে কেমোথেরাপি দিতে হয় । বিহারে এটা ধরা না পড়ার কারণে রোগীর পেট কেটে অস্ত্রোপচার করা হয় । দু'বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল । তাঁর জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয় । এটা যথাযথ চিকিৎসা নয় । সেজন্য রক্তক্ষরণ কমছিল না । এরপর কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যুবতির রোগ নির্ণয় হয়েছিল । কিন্তু, এই হাসপাতালেও এই রোগীর পেট কেটে অস্ত্রোপচার করা হয় । তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিডনির একটি নালি । তার জেরে সবসময় ইউরিন(মূত্র) বের হচ্ছিল । অন্য উপসর্গগুলির কোনও পরিবর্তন হচ্ছিল না ।" সুষমাকে যখন মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয়, তখন তাঁকে প্রাণে বাঁচানোই ছিল চ্যালেঞ্জ ৷ এক বছর আগেই সুষমার কেমোথেরাপি শুরু করা প্রয়োজন ছিল বলে জানান তারাশংকরবাবু ৷ একই বক্তব্য চিকিৎসক অজন্তা সামন্তেরও ৷ তিনি বলেন, "এই রোগী যখন আমাদের এখানে ভরতি হন, তখন তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল । তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছিল । এর পাশাপাশি ছিল অ্যানিমিয়া ৷ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ খুবই কম ছিল ।"
মেডিকেল কলেজে কেমোথেরাপি শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ৷ কিন্তু, হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকায় প্রথমে সমস্যার মুখে পড়েছিলেন চিকিৎসকরা ৷ অজন্তা বলেন, "কেমোথেরাপি শুরুর পর অনেকবার এমন হয়েছে যে বাকি রক্তকণিকাগুলির পরিমাণ অনেক কমে গেছে । পরে তা আবার নিয়ন্ত্রণে আনা হয় ।" তারাশংকরবাবু বলেন, "তিনটি অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের পর রোগীর সমস্যা তৈরি হয়েছিল । এখন ভালো আছেন তিনি । বিপদ মুক্ত বলা যেতে পারে । মোলার প্রেগনেন্সির কারণে এখন তাঁর আর জীবন সংশয় নেই । এরপর ইউরেটর ঠিক করতে হবে । তবে, এক্ষেত্রে রোগী যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন তাঁকে ফলো-আপে রাখতে হবে ৷"
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রেগনেন্সির সময় জরায়ুতে যে প্লাসেন্টা তৈরি হয়, সেখানে টিউমার তৈরি হয় । এটাকেই মোলার প্রেগনেন্সি বলে । 16 থেকে 18 শতাংশ ক্ষেত্রে এই টিউমার ক্যানসারে পরিণত হয় । ভারতে 400টির মধ্যে একটি ক্ষেত্রে মোলার প্রেগনেন্সি হয় । যদি ঠিক মতো রোগনির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসা হয়, তা হলে এটা কোনও সমস্যা নয় বলে বক্তব্য চিকিৎসকদের ৷ তারাশংকরবাবু বলেন, "এটাই একমাত্র ক্যানসার, যেখানে কেমোথেরাপির ফলে রোগী 100 শতাংশ সেরে ওঠেন ৷ অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না । তবে, কেমোথেরাপি না দেওয়া হলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে ।"
তবে জরায়ু বাদ দেওয়ার কারণে সুষমা আর কখনও মাতৃত্বের স্বাদ পাবেন না বলে জানান তারাশংকরবাবু ৷ তবুও মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে এসে মুখে হাসি ফুটেছে সুষমার ৷ বলেন, "চিকিৎসকরা প্রথমে বলেছিলেন, আমি বাঁচতে পারব না । কিন্তু, এখন ভালো আছি ।" তাঁর মা কৌশল্যা দেবী বলেন, "(কলকাতার) ওই বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর সব টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল । জানতে পারি, কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা করানো যাবে । আগে আমরা জানতাম না, এই হাসপাতালে চিকিৎসা হবে । তা হলে আগেই আমরা মেডিকেল কলেজে আসতাম ।"