কলকাতা : রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রবীর ঘোষালের পর এবার তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য দীনেশ ত্রিবেদী একইসঙ্গে দল এবং রাজ্যসভার সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিলেন । ইস্তফা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে বাংলায় যে ভাবে অন্যায়, অত্যাচার, খুন হচ্ছে সেটা তাঁকে চুপ করে সব দেখতে হচ্ছে । "আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাই তাঁর অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে ইস্তফা দিলাম । ছাড়লাম তৃণমূলও । এবার নেতাজি, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ এর বাংলায় মানুষের স্বার্থে কাজ করতে চাই," বলেন দীনেশ ত্রিবেদী ৷
এই ঘটনা কি হতে চলছে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে এক ভয়ানক অশনিসংকেত। যদিও ত্রিবেদীর পদত্যাগের পর দলের পক্ষে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সৌগত রায়ের মতো নেতারা তোপ দাগতে শুরু করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক মহলের ধারণা যে ত্রিবেদীকে শালীনতার সীমা ছাড়ানো আক্রমণ আরও ক্ষতি করবে তৃণমূলের ।
মুকুল রায় বা শুভেন্দু আধিকারীর দল ছাড়ার পর তৃণমূল নেতাদের যুক্তি ছিল যে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত এই নেতারা বিজেপিতে যোগ দিলেন সিবিআই বা ইডির হাত থেকে বাঁচতে । এরপর যখন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রবীর ঘোষাল যখন ছাড়লেন তখন তৃণমূল নেতাদের অর্থনীতিক দুর্নীতির হাত থেকে বাঁচার তত্বটি আর কাজে এল না, কারণ রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ঘোষাল দুজনেরই ব্যক্তিগত ছবি পরিষ্কার এবং দুজনেই ভদ্র এবং বিনয়ী বলে পরিচিত । তখন রাজীবের বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য ছিল যে ভোটের ঠিক আগে মন্ত্রিত্ব ত্যাগের মধ্যে কোনও মহানুভবতা নেই । এমনকী রাজীব বা ঘোষালের নাম না করে তৃণমূলের কেউ কেউ বলেন যে এবারের নির্বাচনে টিকিট পাবে না বুঝে গিয়েই অনেকে দল ছাড়ছেন।
কিন্তু এই সব যুক্তিই ভোঁতা হয়ে যায় ত্রিবেদীর ক্ষেত্রে । পরিছন্ন কালিমাহীন ভাবমূর্তি । ভদ্র এবং মার্জিত কথাবার্তা । একসময়ে তৃণমূল কংগ্রেসে কতিপয় শিক্ষিত এবং সুভদ্র বক্তা। পেয়েছেন সেরা সাংসদের সম্মানও । তাঁর চেয়ে বড় কথা যে রাজ্যসভাতে তাঁর মেয়াদকাল একবছরও পূর্ণ হয়নি। তাই টার্ম শেষ হয়ে আসছে বলেই পদত্যাগ — এই যুক্তিও টিকবে না ত্রিবেদীর বিরুদ্ধে। তাই তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের শুক্রবারে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটাই গোলগোল।
"ভোটার আগে দলকে পিছন থেকে ছুরি মারল বিশ্বাসঘাতক দীনেশ ত্রিবেদী," বলেন তৃণমূলের লোকসভা সদস্য কল্যাণ বন্দোপাধ্যায়। "দীনেশ ত্রিবেদী তাঁর দলের ভিতরে জানাননি। ভোটার আগে তাঁর এই ইস্তফা দুর্ভাগ্যজনক," বলেন তৃণমূল কংগ্রেসের অপর লোকসভা সদস্য সৌগত রায়। এত কিছুর পরেও কিন্তু ত্রিবেদীর পক্ষ থেকে কোনও পালটা কটুকথা বেরোয়নি এখন পর্যন্ত।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক এক তৃণমূল নেতার বলেন যে এমনিতে দলের মধ্যে কোনওরকম বিরোধিতার কথা বলতেন না। "কিন্তু দলের ভোট স্ট্রাটেজিস্ট হিসাবে প্রশান্ত কিশোর বা পিকের আগমন কোনওদিনই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি দীনেশদা। একান্ত ঘনিষ্ট মহলে তিনি দুই একবার বলেছেনও যে তৃণমূল দলটা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল অনেক আত্মত্যাগের কারণে। তাই এবারের নির্বাচনে সব কিছুতেই পিকের খবরদারি উনি মেনে নিতে পারছিলেন না," তৃণমূল কংগ্রেসের এই নেতা বলেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে তিনি আছেন দলের সাথে। 2011 সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রূপে আসীন হওয়ার আগে তাঁর ছেড়ে আসা রেলমন্ত্রীর পদে ত্রিবেদীকেই স্থলাভিষিক্ত করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে রেলের ভাড়া বাড়ানো নিয়ে মমতার সঙ্গে মতবিরোধ হলে তিনি একপ্রকার বাধ্য হয়েই ইস্তফা দেন রেলমন্ত্রীর পদ থেকে। তাঁর জায়গায় রেলমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন মুকুল রায়।
"সেই মুকুল রায় আজ বঙ্গ -বিজেপির এক সেনাপতি এবং তাঁর হাত ধরেই তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে যোগ দিচ্ছেন একের পর এক তৃণমূল নেতা। আজ ত্রিবেদীও পদত্যাগ করলেন দল এবং রাজ্যসভার সদস্যপদ থেকে। খুব অঘটন না হলে তিনিও যে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছন তা বলাই বাহুল্য। এ যেন এক রাজনৈতিক বৃত্ত সম্পূর্ণ হল," মত এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের।
আরও পড়ুন :- রাজ্যসভা থেকে ইস্তফা, তৃণমূলও ছাড়লেন দীনেশ ত্রিবেদী
শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং রাজনীতিপূর্ব পেশাদারি জীবনেও দীনেশের উপস্তিতি ছিল রীতিমতো উজ্জ্বল। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বাণিজ্যের স্নাতক এবং তারপর টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ। কর্মজীবন শুরু শিকাগোর ডেটক্স নামক সংস্থায়। এরপর ভারতবর্ষে ফিরে এসে তিনি যোগদান করেন লি এন্ড মুইরহেডে। এরপর তিনি নিজের ব্যবসা শুরু করেন 1984 সালে। এছাড়াও তিনি একজন প্রশিক্ষিত পাইলট বটে। সেতার বাজানো, শাস্ত্রীয় সংগীত এবং অঙ্কনশিল্পেও তিনি পারদর্শী।