কলকাতা, 17 জুন : রাজ্য রাজনীতিতে এই মুহূর্তে 356 ধারা চর্চিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । নির্বাচন-পরবর্তী হিংসাকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থেকে শুরু করে বিরোধী দলনেতা বারবারই এই বিষয়টির ইঙ্গিত দিচ্ছেন । তাঁরা সরাসরি অবশ্য জরুরি অবস্থার কথা বলছেন না । কিন্তু ঘুরিয়ে এই বিষয় নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার প্রক্রিয়া চলছে ।
কোন সন্দেহ নেই বিরোধী দলে থাকাকালীন তৃণমূল সুপ্রিমোর গলাতেও প্রায় একইভাবে 356-র কথা শোনা গিয়েছে । তবে বহুলাংশে তা ছিল চাপ তৈরির খেলা । কিন্তু এবার প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল । যেভাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একুশের নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছিল, তাতে এই বিষয়টিকে শুধু প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে দেখতে রাজি নন তাঁরা ।
রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বারবার বলছে, আসলে বিজেপি এবং রাজ্যে তার দূত রাজ্যপাল এই পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না । তাই যেনতেন প্রকারে এই সরকারকে বিপাকে ফেলার বা বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে ।
তৃণমূলের তরফে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, রাজ্যপালের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে ।
ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এবং রাজ্যপালের ভূমিকার সমালোচনা করেছে বিশিষ্ট আইনজীবী তথা কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ । তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, এই মুহূর্তে যা চলছে তা অন্যায় । গোটা বিষয়টি সংবিধানসম্মত নয় ।
আরও পড়ুন : বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন ? শাহের মন্তব্য ঘিরে শুরু জল্পনা
অরুণাভ ঘোষের ভাষায়, এঁরা (বিরোধী দলনেতা ও রাজ্যপাল) গণতন্ত্রটাকে শেষ করে দেবেন । এটা সত্যি যে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী ও সমর্থকরা এই মুহূর্তে বহু জায়গায় বিরোধীদের উপর অত্যাচার করছে । সেটা পুলিশের দেখা উচিত । কিন্তু এটাই একমাত্র রাজ্যে 356 ধারা জারি করার জন্য পর্যাপ্ত কারণ হতে পারে না । এদিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তিনি অশিক্ষিত । কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিজেপি নেতারা শিক্ষিত হলেও তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না । আসলে বিজেপি সবকিছুই গায়ের জোরে করতে চাইছে । এর ফল একুশের নির্বাচনে তাঁরা পেয়েছেন । সুতরাং এই অবস্থায় যদি 356 ধারা জারি করা হয়, তা হবে প্রবল হয়ে অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত । সংবিধানে যে বিশেষ পরিস্থিতিগুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলি এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের নেই । সুতরাং এই অবস্থায় কেন্দ্র জোর করে 356 জারি করলেও আদালতে খুব সহজেই চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে । মুখ পুড়বে কেন্দ্রীয় সরকারের ।
এদিন বিরোধী দলনেতার দাবি নিয়ে অরুণাভ ঘোষ বলেন, "একজন রাজনৈতিক দলের নেতা যে কোনও সময়ে এই দাবি করতে পারেন । সংবিধানে তাতে কোনও বাধা নেই । কিন্তু যারা সংবিধান নিয়ে চর্চা করেন তারা নিশ্চয়ই জানেন জনগণের বিপুল সমর্থনে নির্বাচিত একটি সরকারের উপর কয়েক মাসের ব্যবধানে এভাবে 356 ধারা জারি করা যায় না ।"
একই মত সিপিএমের আইনজীবী সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্যের । তিনি বলেন, "রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই । কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হলেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় না । এটা রাজ্যপালের যেমন বোঝা উচিত একইভাবে বিরোধী দলনেতারও বোঝা উচিত ।" তিনি আরও বলেন, "এই মুহূর্তে বিরোধী দলের কর্মীদের উপর হামলা হচ্ছে, তাদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, বহু জায়গায় তাদের জিনিসপত্র লুট করা হচ্ছে । এটা সঠিক । কিন্তু এটা রাষ্ট্রপতি শাসন জারির জন্য কারণ হতে পারে না । বিশেষ করে এই সরকার যখন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে । সরকারকে কাজ করার সময় তো দিতে হবে । এক্ষেত্রে সরকার অপদার্থ হতে পারে । কিন্তু সরকার অপদার্থ হলেই আমি আমার সাংবিধানিক ক্ষমতার অপব্যবহার করব... তা তো হতে পারে না ।"
আরও পড়ুন : বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
মোটের উপর এদিন স্পষ্ট ভাষায় বিকাশবাবু বুঝিয়ে দেন, রাজ্যে 356 ধারা জারির মতো অবস্থা নেই ।
এদিকে রাজ্যপাল এবং বিরোধী দলনেতার বর্তমান বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ড দেখে রাজনৈতিক মহলের একাংশের বলছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেও জানেন এই মুহূর্তে রাজ্যে 356 ধারা জারি হলে তা তাঁদের বিরুদ্ধে যাবে । অতীতে এমন নিদর্শন ভারতবর্ষে রয়েছে, যাতে কেন্দ্র 356 ধারা জারির পর আদালত তা বাতিল করে দিয়েছে । এক্ষেত্রে অনেক ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ করতে হবে কেন্দ্রকে । বিশেষ করে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই সরকারের পিছনে সাধারণ মানুষের বিপুল জনসমর্থন রয়েছে এবং কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অর্থনৈতিক অস্থিরতায় জর্জরিত নয় এই সরকার । সে ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রাজনৈতিক হামলার ঘটনা রাষ্ট্রপতি শাসন জারির জন্য যথেষ্ট নয় । কাজেই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় যত খুশি টুইটই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর জন্য করুন না কেন, আসলে এসব কর্মী-সমর্থকদের মনোবল বাড়ানোর প্রচেষ্টা ।
রাজনৈতিক মহলে এও বলছে, এমনিতেই ভোটের ফল প্রকাশের পর বিজেপি ছাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে নেতা-নেত্রীদের মধ্যে । এই অবস্থায় বিজেপি কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার জন্যই মূলত এই কথাগুলো বলছেন শুভেন্দু অধিকারী । যদি এই মুহূর্তে তিনি এসব না বলেন তাহলে দলের ভাঙ্গন আরো প্রবল হতে পারে । তাই ঘর বাঁচাতেই এই আক্রমণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল ।