কলকাতা, 19 নভেম্বর : গোরু পাচারের শিকড়ের সন্ধানে নেমে নিত্য নতুন তথ্য পাচ্ছে CBI। নিজেদের হেপাজতে পাওয়ার পর BSF কমান্ডান্ট সতীশ কুমারকে ম্যারাথন জেরা শুরু করেছেন তদন্তকারীরা। সূত্র জানাচ্ছে, তাঁর কাছে তদন্তকারীরা জানতে চাইছেন, এরাজ্য গোরু পাচারের টাকার ভাগ পায় কারা ? তদন্তকারীরা মনে করছেন, প্রশাসনের একাংশের যোগসাজশ ছাড়া ব্যাপকহারে গোরু পাচার সম্ভব নয়। পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কোনও প্রভাবশালী এই চক্রে জড়িত কি না।
সূত্রের খবর, তদন্তে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন বড় মাপের গোরু পাচারের আগে BSF-র একশ্রেণির কর্তার সঙ্গে বৈঠক হত পাচারকারীদের। বড় মাপের পাচারের ক্ষেত্রে 35 থেকে 40 লাখ টাকায় রফা হত। পাচারের আগে গোরুর গায়ে বিশেষ ধরনের রং লাগিয়ে দেওয়া হত। সেটাই ছিল সংকেত। চক্রে জড়িত থাকা BSF কর্মীদের ওই রং দেখিয়েই পাচারকারীরা অবলীলায় পাচার করত গোরু। তদন্তে এই ধরনের তথ্যই উঠে আসছে বলে CBI সূত্রে খবর। সূত্রের খবর, গোরু পাচারের তদন্তে BSF CBI-কে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করছে। তাদের ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে CBI জানতে পেরেছে, শুধুমাত্র এই রাজ্য নয়, গোরু পাচারের এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজস্থান, পঞ্জাব, হিমাচলপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, অসম, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।
মূলত এই রাজ্যগুলি থেকে আসে গোরু এবং মোষ। গোরু পাচারের মূল হাব বীরভূম। সেখানেই ভিন রাজ্য থেকে গোরু এবং মোষ এনে রাখা হয়। বীরভূম পর্যন্ত সেগুলি আনা হয় বড় লরিতে। তারপর ছোটো গাড়িতে সেগুলি ছড়িয়ে দেওয়া হয় মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর 24 পরগনায়। তদন্তকারীদের প্রশ্ন, এরাজ্যসহ ভিন রাজ্যের প্রশাসনের মদত ছাড়া এই জিনিস কীভাবে চলতে পারে! দীর্ঘদিন ধরেই এই কারবার চলছে অথচ ওই রাজ্যগুলির পুলিশ বিষয়টি জানে না এটাও কি সম্ভব ? তাছাড়া এরাজ্যে যেভাবে বীরভূম থেকে বিভিন্ন সীমান্ত লাগোয়া জেলায় গোরু নিয়ে যাওয়া হয়, তাতে সবটা প্রশাসনের নজরে আসা উচিত। এপ্রসঙ্গে প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে-আবডালে BSF কর্তারা প্রায়ই রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ আনেন। BSF-র DIG এস এস গুলেরিয়া এপ্রসঙ্গে ETV ভারতকে বলেছিলেন, “বর্ডার ম্যানেজমেন্ট খুব বড় একটা বিষয়। এখানে সীমান্তরক্ষী বাহিনী শুধুই একটা স্টেকহোল্ডার। কিন্তু, আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, সিভিল সোসাইটি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এমনকী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও সীমান্ত রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যখন সবাই মিলে এই কাজ করা হবে তখন কার্যকরী সীমান্ত সুরক্ষা করা যাবে।" অর্থাৎ গোরু পাচার রোধে সর্বোচ্চ সমন্বয় হয় না।
বিষয়টি নিয়ে গত বছর অগাস্ট মাসে ভবনী ভবনে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। তখন BSF-র সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় ছিল না বললেই চলে। ঘনিষ্ঠ মহলে কিংবা ঘরোয়া আড্ডায় BSF কর্তারা এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। এরই মাঝে গত বছর জুনে ঘটে যায় একটি ঘটনা। উত্তর 24 পরগনার এয়ারপোর্ট সংলগ্ন আটঘরা এলাকায় গোরুবোঝাই 14টি ট্রাক আটকায় BSF। সোর্স মারফত BSF-র কাছে খবর ছিল, ওই গোরুগুলো সীমান্ত দিয়ে পাচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওই ট্রাক আটকানোয় নেতৃত্ব দেন BSF কর্তা জি এস চৌহান এবং নীতিশ শর্মা। তারপর খবর দেওয়া হয় স্থানীয় বাগুইআটি থানায়। বিশেষ সূত্র জানাচ্ছে, BSF-র উপর মহল থেকে বিধান নগর পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথা বলা হয়। অনুরোধ করা হয়, ট্রাকগুলি আটক করতে। কিছু পরে ঘটনাস্থানে আসে বাগুইআটি থানার পুলিশ। অভিযোগ, BSF-র থেকে ওই 14টি ট্রাকের চাবি নিয়ে তা দিয়ে দেওয়া হয় গোরু ব্যবসায়ীদের হাতে। পুলিশের পক্ষ থেকে BSF-র বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। বিষয়টিতে ব্যাপক ক্ষুব্ধ হয় BSF। এনিয়ে জল ঘোলা হয় বিস্তর। সূত্র জানাচ্ছে, বিষয়টি জানানো হয় দিল্লিতেও ।
সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার আগেই যদি পাচারকারীদের আটকে দেওয়া যায় তবে অনেকটাই কমতে পারে গোরু পাচার, তেমনটাই মত ছিল BSF-র। এপ্রসঙ্গে গুলেরিয়া ETV ভারতকে বলেন, "রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে গোরু ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয় সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয়। আমরা যদি ওই গোরু সীমান্তে নিয়ে আসার আগেই আটকে দিতে পারি, তবে সমস্যা অনেকটাই কমবে। ঠেকানো যাবে গোরু পাচার। এবিষয়ে পুলিশের সাহায্য প্রয়োজন।" ভবনী ভবনে বৈঠকে এই বিষয়ে কথা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে সব রকম সাহায্য করা হবে বলে জানানো হয় BSF-কে। কিন্তু তার পরেও অভিযোগ উঠছে, সব ধরনের সহযোগিতা প্রশাসনের তরফ থেকে BSF-কে করা হয় না। আর এখানেই CBI বোঝার চেষ্টা করছে, সর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভূতের সংখ্যা কত?