কলকাতা, 6 নভেম্বর: বিরোধী নেত্রী থেকে বাংলার মসনদে আসীন হওয়ার পথে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনই সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের । কিন্তু 2011 থেকে 2021—লাগাতার তিনবার বাংলার মসনদে আসীন হলেও, রাজ্যে কৃষিজমির পরিমাণ ধারাবাহিক ভাবে কমেছে বই বাড়েনি বলে রাজ্য সরকারের নিজের পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে । গত 10 বছরে রাজ্যের কৃষক সমাজের বৃহদাংশ কৃষিকাজ থেকে সরে এসেছে এবং তার ফলেই কৃষিজমির পরিমাণ কমেছে বলে উপলব্ধি সরকারের ।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্য স্টেট অব এনভায়রনমেন্ট, 2021, ওয়েস্ট বেঙ্গল নামের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে । তাতেই উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান ধরা পড়েছে । রিপোর্টে বলা হয়েছে, 2011 সালে অন্তত বছরে একবার চাষ হওয়া কৃষিজমির পরিমাণ ছিল 52 লক্ষ 94 হাজার হেক্টর । কিন্তু 2021 সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে 52 লক্ষ 38 হাজার হেক্টরে । যদিও রাজ্যের দাবি, 2007 সালে, বাম আমল থেকেই কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস পেতে শুরু করে । গত 10 বছরে সেই অবক্ষয়ের গতি আরও বেড়েছে ।
এনিয়ে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইটিভি ভারত । তিনি বলেন, ‘‘এটাকে সভ্যতার কুফল বলতে পারেন । যত সময় যাচ্ছে, জনসংখ্যা যত বাড়ছে, ভিটে-মাটি এবং বাসস্থান জোগাড়ের তাড়নায় কৃষিজমি ধরে রাখা যাচ্ছে না ৷ কৃষিজমির পরিমাণ যে কমছে, তা সত্যিই অস্বীকার করার উপায় নেই ৷ এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে রাজ্য সরকার চাষযোগ্য জমিতে উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়াস চালাচ্ছে ৷ উন্নত মানের এবং উচ্চ ফলনশীল বীজ, আধুনিক প্রযুক্তি, কৃষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, মাটির উর্বরতা পরীক্ষা-সহ একাধিক পদক্ষেপ করা হচ্ছে ফলন বাড়ানো জন্য ৷ একই ভাবে চাষের অযোগ্য জমিকেও চাষযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছি আমরা।’’
আরও পড়ুন: Rishra Jute Mill Chaos : কাজ না পেয়ে শ্রমিক অসন্তোষ, রিষড়ার জুট মিলে ভাঙচুর
কিন্তু যে সরকার জমি আন্দোলনে ভর করে ক্ষমতায় এসেছে, এ ক্ষেত্রে কি দায় এড়াতে পারে তারা ৷ প্রশ্নের উত্তরে শোভনদেব বলেন, ‘‘এটা কোনও সরকারেরই দোষ নয় ৷ সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই এগুলি ঘটে ৷’’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদারও সভ্যতার বিবর্তন এবং নগরায়ণকেই দুষেছেন ৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘কৃষিকাজে যুক্ত না হওয়ার একটা প্রবৃত্তি দেখা যাচ্ছে বর্তমানে ৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে নগরায়ণও কৃষিজমি গ্রাস করেছে ৷ দু’ক্ষেত্রেই আমরা সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি ৷ গত দু’বছরে আমাদের সরকার প্রায় 12 হাজার হেক্টর চাষের অযোগ্য জমিকে চাষযোগ্য করে তুলেছে ৷ আরও 50 হাজার জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার লক্ষ্য রয়েছে ৷’’
গোটা দেশেই কৃষিজমির পরিমাণ কমছে, তবে কৃষকদের দোহাই দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের আমলে এই পরিসংখ্যান যথেষ্ট দুঃখজনক বলে মনে করছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তথা বিজেপি বিধায়ক অশোক লাহিড়ি ৷ তাঁর কথায়, ‘শুধু বাংলাই নয়, গোটা দেশেই কৃষিজমির পরিমাণ কমছে ৷ আগের মতো লাভজনক নেই বলে, চাষাবাদ থেকে সরে যাচ্ছেন বহু মানুষ ৷ তবে দেখতে হবে, পতিত জমিতে পরিণত হওয়া জমিগুলির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না ৷ সেগুলিতে শিল্প গড়ে উঠলে অর্থনীতির পক্ষে শুভ ৷ কিন্তু গত 10 বছরে এ রাজ্যে কোনও বড় শিল্প গড়ে উঠেছে বলে শুনিনি ৷ আবার চাষের জমিও কমে যাচ্ছে ৷ এই পরিসংখ্যান রাজ্যের জন্য সত্যিই হতাশাজনক ৷’’
এ ব্যাপারে অশোকবাবুর সঙ্গে একমত প্রবীণ বাম কৃষক নেতা তথা সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর সদস্য হান্নান মোল্লা । তিনি বলেন, ‘‘কৃষি যে আর লাভজনক নয়, সেটা তো আমরা 2006 সাল থেকেই বলে আসছি । তাই শিল্পায়নের পথে হাঁটতে চেয়েছিলাম ৷ কিন্তু তখন মানুষকে ভুল বুঝিয়েছিল তৃণমূল ৷ আর এখন দেখুন, না আছে শিল্প, না আছে কৃষি ৷ এখন তো কৃষকরা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও পাচ্ছেন না । এটা রাজ্যের পক্ষে সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক ৷’’
আরও পড়ুন: Subrata Mukherjee : প্রিয় সুব্রতদার মৃত্যুতে শোকবিহ্বল বজবজের সারেঙ্গাবাদ
কৃষিকাজের এই পরিস্থিতির জন্যি পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বলে মত প্রাক্তন সাংবাদিক তথা অর্থনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু সান্যালের ৷ তাঁর যুক্তি, কৃষিজমি নিয়ে কৃষকের আবেগ ব্যবহার করে ভোট জেতা এক জিনিস, আর কৃষিকে লাভজনক করে তোলা অন্য জিনিস । একদিকে, কৃষির কাঁচা মালের দাম বেড়েছে । আবার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও পাচ্ছেন না অনেকে ৷ তাই কৃষিকাজ চালিয়ে যাওয়ার সাহসই করছেন না মানুষ ৷ রাজ্যের জমি এবং সেজ নীতিকেও দূরবস্থার জন্য দায়ী করেছেন শান্তুনু ৷ তাঁর দাবি, এতে না হচ্ছে কৃষি, না আসছে শিল্প ৷ শুধু পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যাই বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে ৷