কলকাতা, 23 জানুয়ারি: শুধুই কি বিপ্লব চিন্তা? অসাধারণ বাগ্মীতা। সঙ্গে মেধার অনন্য মিশেল। সুভাষচন্দ্র বসু চরিত্র চিত্রণের অন্য কোনও দিক নেই । 126তম জন্মজয়ন্তীতে চলুন দেখে নিই দেশনায়কের জীবনের অন্যান্য কয়েকটি দিক ৷ যা হয়তো আপনার-আমার অজানা (Unknown Story of Netaji Subhas Chandra Bose)৷
সুগন্ধি বিলাস এবং সুভাষ :
গবেষণা বলছে অন্য দিক আছে নেতাজির জীবনে । গান ভালোবাসতেন । ভালোবাসতেন সুগন্ধি আতর । কলকাতার নাখোদা মসজিদ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে রয়েছে হাজি খুদা বক্স নবি বক্সের আতরের দোকান । 1824 সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে লখনউ থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন ওরা। এই শহরের প্রাচীনতম আতরের দোকান । বর্তমানে নিয়াজউদ্দিন আলহা বক্স এবং তাঁর ভাইপো এই দোকানের মালিক । আট প্রজন্ম ধরে কলকাতার এই অঞ্চলে আতরের ব্যবসা করে চলেছেন । 50 থেকে শুরু করে 4 হাজার টাকা দামের আতর পাওয়া যায় এই দোকানে ।
এখানেই 1940 সাল থেকে নিয়মিত আতর কিনতে আসতেন সুভাষচন্দ্র বসু । তাঁর নিয়মিত আসার খবর পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শুনেছেন বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধিরা । সুভাষচন্দ্রের সুগন্ধি প্রীতির উল্লেখ তাঁর মেজ বৌদিকে জেল থেকে লেখা চিঠিতেও রয়েছে । সেখানে গান এবং গন্ধের অভাব বোধ করার কথা বলেছেন তিনি । তবে শুধু সুভাষচন্দ্র নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পণ্ডিত জহরলাল নেহরুও এই দোকান থেকে আতর সংগ্রহ করতেন বলে জানাচ্ছেন দোকানীরা ।
শুধু এই একটি দোকান নয়, তাঁর সুগন্ধি প্রীতির জন্য কলকাতার টেরিটি বাজারের পাশে সান ইয়েত সেন স্ট্রিটের আলি পারফিউমের সঙ্গেও রয়েছে সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্ক রয়েছে । মহম্মদ আলি এবং মহম্মদ ইসমাইলের বাবা মহম্মদ হানিফ সেই সময় ছিলেন রেঙ্গুন প্রবাসী। তিনি নেতাজির ডাকে আজাদ হিন্দ ব্যাংকে চাঁদা দিয়ে যেতেন । সেই রশিদ আজও রয়েছে এই ছোট্ট দোকানের স্টোর রুমে । হানিফ মহম্মদ বিশ্বাস করতেন স্বাধীনতা আসতে পারে একমাত্র নেতাজির হাত ধরেই ।
আরও পড়ুন : প্রেমিকাকে চিঠি থেকে গোপনে বিপ্লবী যোগ, নেতাজির স্মৃতি আগলাচ্ছে গিদ্দা পাহাড়ের বাড়ি
গোষ্ঠ পাল এবং সুভাষচন্দ্র বসু:
স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে কলকাতা ময়দানের যোগাযোগের কথা জানা গিয়েছে । টাউন ক্লাবের হয়ে নরেন্দ্রনাথ দত্ত ক্রিকেট ও ফুটবল খেলতেন নিয়মিত । কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু কি খেলাধূলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন ? ইতিহাস বলছে সাহেবী স্কুলে পড়াশোনা, পরবর্তী সময়ে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং স্কটিশচার্চ কলেজে পড়লেও বল পায়ে কিংবা হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তাঁর হদিশ নেই । তবে তিনি মোহনবাগান ক্লাবের সমর্থক ছিলেন । সেটা ছিলেন কারণ সেই সময় মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে দেশাত্মবোধ জড়িয়ে ছিল । সেই আমলের চাইনিজ ওয়াল বলে পরিচিত গোষ্ঠ পালের খেলা দেখতে তিনি মোহনবাগান মাঠেও গিয়েছিলেন বলে শোনা যায় ।
"কেউ যদি দেশের কথা ভেবে থাকেন, তিনি একমাত্র নেতাজি । তিনি থাকলে দেশভাগ হত না ৷" এমনটাই মনে করতেন কিংবদন্তি ফুটবলার গোষ্ঠ পাল । বয়সে সুভাষচন্দ্র বসুর থেকে বড় হলেও তাঁর প্রতি বিরাট শ্রদ্ধা ছিল গোষ্ঠ পালের। নেতাজির মত সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নিয়েও খেলার মাঠে বারবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার । শোনা যায় ছদ্মবেশে গোষ্ঠ পালের খেলা দেখতে এসেছিলেন নেতাজি । সেই সময় ফুটবলার হিসেবে গোষ্ঠ পাল বেশ নাম করেছিলেন কলকাতা ময়দানে । ফুটবল মাঠে গোরাদের দলকে আটকে দিচ্ছেন খালি পায়ে । গোষ্ঠ পালের অকুতোভয় ফুটবল সমীহ করতেন সাহেব ফুটবলাররা । ফলে মোহনবাগান, গোষ্ঠ পাল নিয়ে দেশাত্মবোধ গড়ে উঠেছে ।
আরও পড়ুন : নেতাজি থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তিলোত্তমার রাস্তায় তাঁদের ব্যবহৃত গাড়ি
অন্যদিকে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন সুভাষচন্দ্র বসুও । এর মাঝেই মোহনবাগানের ভক্ত সুভাষও ময়দানে খেলা দেখতে এসেছিলেন । আসলে ফুটবল নিয়ে আলাদা একটা আবেগ কাজ করত তাঁর মধ্যে । তাই বিপদ হতে পারে জেনেও ছদ্মবেশে মোহনবাগানের ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন সুভাষ । গোষ্ঠ পালের পুত্র নীলাংশু পাল বলেন," কোনওদিনই নেতাজির সঙ্গে আমার বাবার সামনাসামনি দেখা হয়নি । তবে বাবার প্রতিও নেতাজির শ্রদ্ধা ছিল । আবার উলটো দিকে বাবাও নেতাজির কথা বলতেন বারবার ।" এরপর সেই ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে আবেগে গলা ধরে আসে নীলাংশুর । তিনি বলেন, "বাবা সেই সময় মোহনবাগানের হয়ে খেলছেন । খেলাটা ছিল ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবের বিরুদ্ধে । এখনকার মোহনবাগান মাঠে । মনে করিয়ে দিই, এখন যেখানে মোহনবাগান তাঁবু, তখন কিন্তু সেখানে ছিল না । অর্থাৎ খেলাটা মোহনবাগানের ঘরের মাঠে নয় । সেই ম্যাচে জিতেছিল সবুজ-মেরুন ক্লাব । বাবা জানতেন না তাঁর খেলা দেখতে হাজির হয়েছেন স্বয়ং নেতাজি । কারণ তিনি এসেছিলেন ছদ্মবেশে । খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, বাবাকে একজন এই খবর জানান ।"
নেতাজি গোষ্ঠ পালের খেলা দেখে দারুণ খুশি হয়েছিলেন বলে শোনা যায় । যদিও তার আগে বা পরে নেতাজির সঙ্গে আর দেখা করার সুযোগ হয়নি গোষ্ঠ পালের । দূর থেকে হলেও থেকে গিয়েছে সেই শ্রদ্ধা আর ভালবাসা । নীলাংশু আরও জানান, তাঁর বাবা মনে করতেন সুভাষচন্দ্র বসু থাকলে ভারতের এমন অবস্থা হত না। আটকে দেওয়া যেত দেশভাগও। ইস্টবেঙ্গলে খেলে যাওয়া হরমনজোৎ সিং খাবরার দাদু সর্দার উধম সিং ছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদস্য। নেতাজির সম্পর্কে তাঁরা আজও শ্রদ্ধাশীল। হরমনজোৎ সিং খাবরা জানান, তাঁদের বাড়িতে আজও অটুট নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা।
খাদ্য বিলাস এবং সুভাষচন্দ্র বসু:
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের বাটা মশলার রান্না খেতে প্রায়ই চলে আসতেন সুভাষচন্দ্র । কটক থেকে আসা মানব পাণ্ডা কাজের খোঁজে কলকাতায় এসে খুলেছিলেন এই হিন্দু হোটেল । সেখানেই পুঁইশাকের চচ্চড়ি, মৌরলা মাছ, বেগুন পোড়া ও ডাল দিয়ে কবজি ডুবিয়ে খেতেন সুভাষ । কোন কোনও দিন বন্ধুবান্ধবদের নিয়েও চলে আসতেন এখানে । দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই হোটেলের নাম হয় স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল ।
আরও পড়ুন : নেতাজিকে নিয়ে স্কুলছাত্রের 'অপূর্ব সৃষ্টি'