কলকাতা, 11 অগাস্ট : এক COVID-19 রোগীর মৃত্যুর 12 ঘণ্টা পরে, মৃত রোগীর ছেলে জানতে পারলেন যে তাঁর বাবা আর বেঁচে নেই । হাসপাতাল থেকে এই খবর জানার পরে পরিজনরা শ্মশানে গেলেন । শেষ বারের মতো প্রিয়জনের মুখ একবার দেখতে চাইলেন । অভিযোগ, শ্মশানে গিয়ে মৃত ওই রোগীর ছেলেকে শুনতে হয়, তাঁর বাবার মুখ দেখতে হলে 51 হাজার টাকা দিতে হবে । 51 হাজার টাকা দেওয়া হলে "ইন্ডিয়ান সিস্টেম" অনুযায়ী অন্তিম সংস্কারের সব কাজ করে দেওয়া হবে । শেষ পর্যন্ত 2,500 টাকা দিয়ে এক ঝলকের জন্য মৃত বাবার মুখ শেষ বারের মতো দেখলেন যুবক ।
COVID-19-এ আক্রান্ত 56 বছর বয়সি মৃত এই রোগী হাওড়ার সালকিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন । মৃত এই রোগীর ছেলে জানিয়েছেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর বাবার । তাই গত 23 জুলাই বড়বাজারে অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালে তাঁর বাবাকে ভরতি করানো হয়েছিল । COVID-19 টেস্টের রিপোর্টে গত 25 জুলাই জানা যায় এই রোগীর COVID-19 পজ়িটিভ । এরপর ওই হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা চলছিল । 11 দিন পরে এই রোগীকে হোম কোয়ারানটিনে রাখার জন্য হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল । গত 3 অগাস্ট বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীকে ।
তবে, শরীর খারাপ হওয়ার কারণে গত 7 অগাস্ট সকালে COVID-19-এর হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করেন ওই রোগীর ছেলে । তিনি জানিয়েছেন, এরপর কন্ট্রোল রুম থেকে তাঁকে জানানো হয়, তাঁর বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে । এর জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হবে । হাওড়ার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় । গত ৭ অগাস্ট সন্ধ্যা নাগাদ তাঁর বাবাকে ফোন করে তিনি জানতে পারেন, অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁর বাবাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । তখন ওই হাসপাতালে ফোন করে তিনি জানতে পারেন, তাঁর বাবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে । বেটার ট্রিটমেন্টের জন্য অন্য হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে । বিস্তারিত তথ্যের জন্য তাঁকে কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে বলা হয় । কন্ট্রোল রুমে ফোন করে তাঁর বাবাকে অন্য হাসপাতালে রেফারের বিষয়ে তিনি জানতে পারেন ।
মৃত এই রোগীর ছেলে জানিয়েছেন, কন্ট্রোল রুমে অন্য হাসপাতালের ফোন নম্বর তিনি চান । অভিযোগ, পরে ফোন করতে বলা হয় । যদি, খুব প্রয়োজন হয় তা হলে তাঁর বাবাকে ফোন করে নিতে বলা হয় । ওই দিন তিনি কন্ট্রোল রুম থেকে ওই অন্য হাসপাতালের ফোন নম্বর আর পাননি । পরের দিন সকালে কন্ট্রোল রুমে ফোন করে, অনেক বার বলার পরে ওই অন্য হাসপাতালের ফোন নম্বর তিনি পান । অন্য এই হাসপাতালটি হাওড়ার ফুলেশ্বরের কাছে অবস্থিত একটি বেসরকারি হাসপাতাল । গত 8 অগাস্ট ওই হাসপাতালে ফোন করে মৃত এই রোগীর ছেলে জানতে পারেন, তাঁর বাবার শারীরিক অবস্থা ক্রিটিক্যাল । ওই দিন সন্ধ্যার সময় তাঁর বোন তাঁর বাবার নম্বরে ফোন করে কথা বলেন । তাঁর বাবা জানান, তিনি ভালো নেই । তখন কন্ট্রোল রুম থেকে দেওয়া হাসপাতালের ওই নম্বরে মৃত এই রোগীর ছেলে আবার ফোন করেন । তবে কেউ ফোন তোলেননি বলে অভিযোগ । পরের দিন, 9 অগাস্ট সকালে তিনি, তাঁর কাকা এবং মা তাঁর বাবার নম্বরে ফোন করেন । তাঁর বাবার ফোন কেউ রিসিভড করেননি ।
মৃত রোগীর ছেলে বলেন, "তখন কন্ট্রোল রুম থেকে ওই হাসপাতালের যে নম্বর দেওয়া হয়েছিল, সেই নম্বরে আমি ফোন করি । সেখান থেকে আমাকে বলা হয়, আমার বাবার শারীরিক অবস্থা ঠিক নেই । আমাকে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ফোন করবেন । তখন আমি আবার কন্ট্রোল রুমে ফোন করি ।" কন্ট্রোল রুম থেকে তিনি জানতে পারেন, তাঁর বাবার শারীরিক অবস্থা ক্রিটিক্যাল । তাঁকে ওই বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ফোন করা হবে । তাঁর ফোন নম্বর খোঁজ করা হচ্ছিল । তাঁর ফোন নম্বর তাঁদের কাছে ছিল না । মৃত এই রোগীর ছেলে বলেন, "কন্ট্রোল রুমের এক ম্যাডামের সঙ্গে তিন দিন আমি ফোনে কথা বললাম । বাবাকে বাড়ি থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য, হাসপাতাল (প্রথম) থেকে আমাকে ফোন করা হয়েছিল । ওই ম্যাডাম-ই আমার ফোন নম্বর ওই হাসপাতালে দিয়েছিলেন বলেই না ওই হাসপাতাল থেকে আমাকে ফোন করা হয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হবে বলে । এর পরেও ওই ম্যাডাম আমাকে বলেন, আমার কোনও মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া নেই, ঠিকানা নেই ।"
মৃত এই রোগীর ছেলে বলেন, "আমার ফোন নম্বর হাসপাতালে দেওয়ার কথা বলি ওই ম্যাডামকে । এক ঘণ্টা পরে দুপুর একটা নাগাদ ওই হাসপাতাল থেকে আমার কাছে ফোন আসে । ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, 8 অগাস্ট রাত একটা (অর্থাৎ, 9 অগাস্ট) নাগাদ আমার বাবার মৃত্যু হয়েছে । আমার বাবার মৃত্যুর 12 ঘণ্টা পরে আমাকে জানানো হল, আমার বাবা বেঁচে নেই ।" তিনি বলেন, "হাসপাতাল থেকে বলা হয়, বিকাল চারটে নাগাদ বাবার দেহ শিবপুর শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হবে । বাবাকে দেখতে হলে আমরা ওখানে যেতে পারি । আমরা শিবপুর শ্মশান ঘাটে যাই ।"
তারপর ? মৃত এই রোগীর ছেলে বলেন, "শ্মশানের একজন ছেলে আমাকে বলেন, বাবার যদি অন্তিম সংস্কার করতে হয় এবং মুখ দেখতে হয়, তা হলে আমাকে 51 হাজার টাকা দিতে হবে । 51 হাজার টাকা দেওয়া হলে ইন্ডিয়ান সিস্টেম অনুযায়ী অন্তিম সংস্কারের সব কাজ করে দেওয়া হবে । আমরা বলি, আমাদের কাছে 51 হাজার টাকা নেই । 10-11 হাজার টাকা দিতে পারি । কিন্তু, এই টাকা নিতে চাইছিলেন না, 51 হাজার টাকা দাবি করছিল ।" তিনি বলেন, "তখন ওখানে পুলিশ আসে । আমরা পুলিশকে বলি বাবার মুখ দেখতে দেওয়ার জন্য । পুলিশ কথা শোনেনি । ওখানে তখন মিডিয়া আসে । তখন কী হল জানি না, শ্মশানের ওই ছেলেটি তখন আমাকে একটু সাইডে ডেকে নিয়ে বলেন, 2,500 টাকা দিলে বাবার মুখ দেখতে দেওয়া হবে । আমি 2,500 টাকা দিই । আমাকে তখন এক ঝলক বাবার মুখ দেখানো হয় ।" এই বিষয়ে কোথাও অভিযোগ জানাবেন ? তিনি বলেন, "আমার বাবা তো চলে গিয়েছেন । অভিযোগ জানানোর জন্য মানসিকভাবে আমি প্রস্তুত নই । আমার অনুরোধ, পরের বার যেন এমন ঘটনা অন্য আর কারও সঙ্গে না হয় ।" এই অভিযোগের বিষয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "বিষয়টি বিশদে যাচাই করে দেখা প্রয়োজন ।"
মৃত্যুর 12 ঘণ্টা পরে মৃত রোগীর ছেলে জানতে পারেন যে তাঁর বাবা বেঁচে নেই । এই বিষয়ে হাওড়ার ফুলেশ্বরের কাছে অবস্থিত বেসরকারি ওই হাসপাতালের অধিকর্তা চিকিৎসক শুভাশিস মিত্রর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "গত 7 অগাস্ট সন্ধ্যার পরে খারাপ অবস্থায় এই রোগীকে আমাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল । এই রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল । গত 8 অগাস্ট রাত একটা নাগাদ এই রোগীর মৃত্যু হয় ।" তিনি বলেন, "মৃত রোগীর পরিবারকে আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি ।" এর পাশাপাশি তিনি বলেন, "মৃত এই রোগীর বাড়ির কোনও ফোন নম্বর আমাদের কাছে ছিল না । অনেক চেষ্টার পরে ফোন নম্বর যখন পেয়েছিলাম, আমরা তখন মৃত এই রোগীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম । সংক্রমণ যাতে আরও ছড়িয়ে না পড়ে, তার জন্য হাসপাতালে আমরা সাধারণত আসতে মানা করি । এই কারণে মৃত এই রোগীর পরিবারকে শ্মশানঘাটে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল ৷" অথচ, মৃত এই রোগীর ছেলে জানিয়েছেন, কন্ট্রোল রুম থেকে দেওয়া হাসপাতালের একটি ফোন নম্বরে গত 9 অগাস্ট সকালে ফোন করে তিনি জানতে পারেন তাঁর বাবার শারীরিক অবস্থা ঠিক নেই । বেসরকারি ওই হাসপাতালের অধিকর্তা বলেন, "আমাদের যে কর্মীর সঙ্গে মৃত এই রোগীর ছেলের কথা হয়েছিল, ওই দিন অত সকালে এই কর্মীর কাছে এই রোগীর মৃত্যুর খবর ছিল না ।"