ETV Bharat / state

জন্মদিনে আজ রাসবিহারী বসুরই রেসিপি... - ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ

2001 সাল থেকে রাসবিহারী বসুর সেই রেসিপি রেডি-টু-ইট হিসেবেও বিক্রি করা হয় এখন । নাকামুরায়া প্রসেসড ফুড ডিভিশন তৈরি হয়েছে 2016 সালে । আর হ্যাঁ, রেস্তরাঁয় গেলেই গ্রাহকরা দেখতে পান ধুতি পরিহিত রাসবিহারী বসুর ছবি । পাশে বসে আছেন কিমোনো পরিহিত তাঁর স্ত্রী তোশিকো ।

Ras Behari Bose and his recipe
জন্মদিনে আজ রাসবিহারী বসুরই রেসিপি.
author img

By

Published : May 25, 2020, 7:01 PM IST

Updated : May 25, 2020, 7:35 PM IST

কলকাতা : পূর্ব বর্ধমানের দামোদরপাড়ে কাদামাটির গন্ধমাখা গ্রাম সুবলদহর সঙ্গে সুদূর জাপানের ঝাঁ চকচকে টোকিয়ো শহরের যোগ আছে কি ? পাঠক বলবেন, নেই । তবে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যদি একটু উঁকিঝুকি দেওয়া যায়, একটা সূক্ষ্ম যোগ পাওয়া যাবে । সুবলদহ হোক বা টোকিও-একটি বিন্দুতে মিলে যাবে বিশ্বের দু'প্রান্তের দুটি স্থান । মাটির টান ।

তবে, সুবলদহের সঙ্গে যতটা না ওঠাবসা করেছেন বরেণ্য বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, টোকিয়োকে সঙ্গ দিয়েছেন অনেক বেশি । সেসব স্মৃতি ছুঁতে গেলে ফিরে যেতে হবে অনেকটা পিছনে । 1889 সালে মায়ের যখন মৃত্যু হয়, রাসবিহারী বসু তিনবছরের শিশু । কোলেপিঠে বড় হন মাসি আর দাদুর কাছে । তারপর বাল্যকালের সুবলদহ ছেড়ে চন্দননগরে কলেজে পড়াশোনা । পরে দেহরাদুন । ক্লার্কের কাজ নেন ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে । বিপ্লবের জোয়ার দেশে তখন তুঙ্গে । অগ্রণী ভূমিকায় রাসবিহারী বসু ।

বিভিন্ন লেখালেখি থেকে পাওয়া যায়, আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেপ্তারি এড়াতে কলকাতা ছাড়েন 1908 সালে । তারপর দিন যত গড়িয়েছে, বৈপ্লবিক পরিকল্পনার গাঁথনি তৈরি হয়েছে একটু একটু করে । আর অপেক্ষা করেছেন পরিকল্পনা রূপায়ণের ।

1912 সাল । দিল্লির চাঁদনি চকে তৎকালীন ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে বোমা মেরে হত্যার চেষ্টা । যার মাথা ছিলেন রাসবিহারী বসু । নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশ সরকার । শুরু হয় ধরপাকড় । রাসবিহারী বসু আত্মগোপন করেন । ধরা পড়েন লালা হনুমন্ত সহায়, বসন্তকুমার বিশ্বাস, ভাই বালমুকুন্দ, আমির চাঁদ এবং অবধ বিহারী । বিচারে ফাঁসির আদেশ হয় লালা হনুমন্ত সহায় বাদে আর তিনজনের ।

তারপরেও থেমে থাকেননি তিনি । উলটে দৃঢ় হয় বিপ্লব । ভারতীয় সেনার মধ্যে বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন । তবে ব্যর্থ হয় সে চেষ্টা । আমেরিকানিবাসী গদর পার্টির এক নেতা ততদিনে গোপনে ভারতে ফিরে এসেছেন । রাসবিহারী বসুর সঙ্গে পরিকল্পনা করে মেরঠে সেনা-বিদ্রোহে নকশা আঁকতে লাগেন । তবে সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয় । অন্যদের ধরতে সমর্থ হলেও ব্রিটিশ পুলিশ রাসবিহারী বসুর সন্ধান পায়নি । পোস্টার ছাপিয়ে, খবরের কাগজে ছবি ছাপিয়ে, নগদ পুরস্কার ঘোষণা করে রাসবিহারী বসুকে ধরতে তখন মরিয়া তারা ।

Ras Behari Bose
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাসবিহারী বসু ও পরিবার ৷ ছবি সৌজন্যে: nakamuraya.co.jp

এই অবস্থায় ঘনিষ্ঠমহল থেকে দেশত্যাগের পরামর্শ পেলেন রাসবিহারী । সেটা 1915 সাল । একদিন ছদ্মবেশে জাপানের জাহাজে চড়ে বসলেন । ছদ্মনাম প্রিয়নাথ ঠাকুর । 8 জুন পৌঁছলেন জাপানে । কোবে শহরে । সেখান থেকে ট্রেনে পৌঁছন টোকিয়ো । দেখা হয় চিনের প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা সান ইয়াৎ সেনের সঙ্গে । সেখানে স্থানীয় এক পুলিশকর্মীর সহায়তায় থাকার জায়গার ব্যবস্থা করেন এবং ফের শুরু করেন বিপ্লবী কার্যকলাপ । স্বদেশের অন্য বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন সেখান থেকেই । পাঠাতে থাকেন আগ্নেয়াস্ত্র । ততদিনে আলাপ হয়েছে সেদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মিতসুরু তোয়ামার সঙ্গে ।

এই সময় তাঁর খোঁজে চুপ করে বসে ছিল না ব্রিটিশও । কোথায় রাসবিহারী বসু? তা জানতে গোয়েন্দা লাগিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছিল তারা । অবশেষে খবর এল, প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে জাপানে রয়েছেন যিনি, তিনিই রাসবিহারী বসু । তাঁকে তাদের হাতে তুলে দিতে জাপানের কাছে অনুরোধ জানায় ব্রিটিশ সরকার । তবে তা সফল হয়নি । রাসবিহারী বসুর জাপান-স্থিত শুভানুধ্যায়ীরা তাঁর বিকল্প আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন । শিঞ্জুকু শহরে নাকামুরায়া বলে একটি বেকারি ছিল । মিতসুরু তোয়ামার হস্তক্ষেপে সেই বেকারির মালিকপক্ষের সঙ্গে আলাপ হয় রাসবিহারী বসুর । এলাকার স্বনামধন্য সোমা পরিবার । তাদের সহায়তায় বেকারির ঠিক পিছনে পরিত্যক্ত একটি স্টুডিয়োয় আশ্রয় নেন রাসবিহারী বসু । সঙ্গী আরেক বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত ।

Ras Behari Bose
INA-তে রাসবিহারী বসু ৷ ছবি সৌজন্যে: nakamuraya.co.jp

তারপর সময় যত এগিয়েছে আরও ঘটনাবহুল হয়েছে রাসবিহারীর জীবন । ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে নাকামুরায়া বেকারির মালিক কোক্কো ও সোমা পরিবারের সঙ্গে । কোক্কোর বড়মেয়ে তোশিকোর সঙ্গে আলাপ হয়েছে । শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী । 1916 থেকে আরও বছর দুই জাপানের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন রাসবিহারী । রাজনৈতিক নানা কারণে ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি থেকে তখনও অব্যাহতি পাননি । গোয়েন্দারা লেগে রয়েছে পিছনে । এরমধ্যেই মিতসুরু তোয়ামা কথাটা একদিন পেড়েই ফেললেন সোমা দম্পতির কাছে । প্রস্তাব দিলেন রাসবিহারী-তোশিকোর বিয়ের । শুরুতে নাকি মত দেননি রাসবিহারী বসু । প্রস্তাব শুনে উত্তর আসতে দেরি হয়েছিল তোশিকোর কাছ থেকেও । তবে শেষমেশ চারহাত এক হয়েই যায় । 1918-র 9 জুলাই । তোশিকো সোমা থেকে তোশিকো বসু । প্রেম শুরু । গাঢ় হতে লাগল সে প্রেম ।

তারপরও যে থিতু হয়েছিল তাঁদের জীবন, তেমনটা নয় । গোয়েন্দা তাড়া খেয়ে বাস পালটাতে হয়েছে অনেকবার । তোশিকোর শারীরিক অবস্থাও বেগ দিয়েছে নবদম্পতিকে । দ্বন্দ্ব-দোটানার মাঝেই 1920 ও 1922 সালে তোশিকোর কোলে এসেছে তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে । আর তার ঠিক তিনবছর পর প্রেমের বাঁধন ছিঁড়ে রাসবিহারী বসুকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন তোশিকো । নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে । মাত্র 28 বছর বয়সে ।

গভীর দুঃখ গ্রাস করে রাসবিহারী বসুকে । কিন্তু তাকে কার্যত দৃঢ় লড়াইয়ে পরিবর্তিত করে ফেলেন তিনি । আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন । তৈরি করেন ইন্ডিয়ান ক্লাব । বিপ্লবী নানা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেন, নাকামুরায়া বেকারির উপরে খুলবেন ছোট্ট রেস্তরাঁ । সাহায্য করবেন শ্বশুরকে । আর তাঁর রেস্তরাঁয় মিলবে ভারতীয় ভাত-তরকারি । রেস্তরাঁর সেই ইন্দো-কারির রেসিপিতে নাকি তাঁর বিশেষ নজর থাকত । তিনি চাইতেন, এশিয়ার অন্যান্য দেশের মানুষ ভারতের স্বাদ-সংস্কৃতির মিষ্টত্ব সম্পর্কে জানুক । 1927 সাল থেকে নাকামুরায়ার মেনুতে ইন্দো-কারি থাকতে শুরু করে । খুব তাড়াতাড়ি খাদ্যরসিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে যায় সেই পদ ।

ততদিনে বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও উল্লেখযোগ্য মোড় নিয়েছে । 1942 সালে তৈরি করেছেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তৈরি করে ফেলেছেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি । পরে 1943 সালের মে মাসে বার্লিন থেকে জাপানে আসেন আরেক বরেণ্য বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু । দু'জনের সাক্ষাৎ । মাসখানেক পরে প্রিয় সুভাষচন্দ্রের হাতে INA-র দায়িত্ব তুলে দেন রাসবিহারী বসু ।

স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে । 1944 সালে ফুসফুসের সমস্যায় কাহিল হয়ে পড়েন । 1945 সালের 21 জানুয়ারি 58 বছর বয়সে ভারতমাতার অন্যতম এই বীর সন্তানের মৃত্যু হয় । শোনা যায়, যখন তিনি হাসপাতালে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন, ডাক্তার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁর খেতে ইচ্ছে করছে কি না । রাসবিহারী বসুর উত্তর ছিল, “কেন খেতে ইচ্ছে করবে ! আমি যা সবথেকে খেতে ভালোবাসি, নার্সরা তো তা আমায় দেয় না ।” ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী সেই খাবার? রাসবিহারী বসুর উত্তর নাকি ছিল, “নাকামুরায়ার ভারতীয় কারি ।”

সেই ইন্দো-কারি আজও সমান জনপ্রিয় টোকিয়োয় । বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, 2001 সাল থেকে রাসবিহারী বসুর সেই রেসিপি রেডি-টু-ইট হিসেবেও বিক্রি করা হয় এখন । নাকামুরায়া প্রসেসড ফুড ডিভিশন তৈরি হয়েছে 2016 সালে । আর হ্যাঁ, রেস্তরাঁয় গেলেই গ্রাহকরা দেখতে পান ধুতি পরিহিত রাসবিহারী বসুর ছবি । পাশে বসে আছেন কিমোনো পরিহিত তাঁর স্ত্রী তোশিকো ।

কলকাতা : পূর্ব বর্ধমানের দামোদরপাড়ে কাদামাটির গন্ধমাখা গ্রাম সুবলদহর সঙ্গে সুদূর জাপানের ঝাঁ চকচকে টোকিয়ো শহরের যোগ আছে কি ? পাঠক বলবেন, নেই । তবে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যদি একটু উঁকিঝুকি দেওয়া যায়, একটা সূক্ষ্ম যোগ পাওয়া যাবে । সুবলদহ হোক বা টোকিও-একটি বিন্দুতে মিলে যাবে বিশ্বের দু'প্রান্তের দুটি স্থান । মাটির টান ।

তবে, সুবলদহের সঙ্গে যতটা না ওঠাবসা করেছেন বরেণ্য বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, টোকিয়োকে সঙ্গ দিয়েছেন অনেক বেশি । সেসব স্মৃতি ছুঁতে গেলে ফিরে যেতে হবে অনেকটা পিছনে । 1889 সালে মায়ের যখন মৃত্যু হয়, রাসবিহারী বসু তিনবছরের শিশু । কোলেপিঠে বড় হন মাসি আর দাদুর কাছে । তারপর বাল্যকালের সুবলদহ ছেড়ে চন্দননগরে কলেজে পড়াশোনা । পরে দেহরাদুন । ক্লার্কের কাজ নেন ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে । বিপ্লবের জোয়ার দেশে তখন তুঙ্গে । অগ্রণী ভূমিকায় রাসবিহারী বসু ।

বিভিন্ন লেখালেখি থেকে পাওয়া যায়, আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেপ্তারি এড়াতে কলকাতা ছাড়েন 1908 সালে । তারপর দিন যত গড়িয়েছে, বৈপ্লবিক পরিকল্পনার গাঁথনি তৈরি হয়েছে একটু একটু করে । আর অপেক্ষা করেছেন পরিকল্পনা রূপায়ণের ।

1912 সাল । দিল্লির চাঁদনি চকে তৎকালীন ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে বোমা মেরে হত্যার চেষ্টা । যার মাথা ছিলেন রাসবিহারী বসু । নড়েচড়ে বসে ব্রিটিশ সরকার । শুরু হয় ধরপাকড় । রাসবিহারী বসু আত্মগোপন করেন । ধরা পড়েন লালা হনুমন্ত সহায়, বসন্তকুমার বিশ্বাস, ভাই বালমুকুন্দ, আমির চাঁদ এবং অবধ বিহারী । বিচারে ফাঁসির আদেশ হয় লালা হনুমন্ত সহায় বাদে আর তিনজনের ।

তারপরেও থেমে থাকেননি তিনি । উলটে দৃঢ় হয় বিপ্লব । ভারতীয় সেনার মধ্যে বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন । তবে ব্যর্থ হয় সে চেষ্টা । আমেরিকানিবাসী গদর পার্টির এক নেতা ততদিনে গোপনে ভারতে ফিরে এসেছেন । রাসবিহারী বসুর সঙ্গে পরিকল্পনা করে মেরঠে সেনা-বিদ্রোহে নকশা আঁকতে লাগেন । তবে সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয় । অন্যদের ধরতে সমর্থ হলেও ব্রিটিশ পুলিশ রাসবিহারী বসুর সন্ধান পায়নি । পোস্টার ছাপিয়ে, খবরের কাগজে ছবি ছাপিয়ে, নগদ পুরস্কার ঘোষণা করে রাসবিহারী বসুকে ধরতে তখন মরিয়া তারা ।

Ras Behari Bose
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাসবিহারী বসু ও পরিবার ৷ ছবি সৌজন্যে: nakamuraya.co.jp

এই অবস্থায় ঘনিষ্ঠমহল থেকে দেশত্যাগের পরামর্শ পেলেন রাসবিহারী । সেটা 1915 সাল । একদিন ছদ্মবেশে জাপানের জাহাজে চড়ে বসলেন । ছদ্মনাম প্রিয়নাথ ঠাকুর । 8 জুন পৌঁছলেন জাপানে । কোবে শহরে । সেখান থেকে ট্রেনে পৌঁছন টোকিয়ো । দেখা হয় চিনের প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা সান ইয়াৎ সেনের সঙ্গে । সেখানে স্থানীয় এক পুলিশকর্মীর সহায়তায় থাকার জায়গার ব্যবস্থা করেন এবং ফের শুরু করেন বিপ্লবী কার্যকলাপ । স্বদেশের অন্য বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন সেখান থেকেই । পাঠাতে থাকেন আগ্নেয়াস্ত্র । ততদিনে আলাপ হয়েছে সেদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মিতসুরু তোয়ামার সঙ্গে ।

এই সময় তাঁর খোঁজে চুপ করে বসে ছিল না ব্রিটিশও । কোথায় রাসবিহারী বসু? তা জানতে গোয়েন্দা লাগিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছিল তারা । অবশেষে খবর এল, প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে জাপানে রয়েছেন যিনি, তিনিই রাসবিহারী বসু । তাঁকে তাদের হাতে তুলে দিতে জাপানের কাছে অনুরোধ জানায় ব্রিটিশ সরকার । তবে তা সফল হয়নি । রাসবিহারী বসুর জাপান-স্থিত শুভানুধ্যায়ীরা তাঁর বিকল্প আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন । শিঞ্জুকু শহরে নাকামুরায়া বলে একটি বেকারি ছিল । মিতসুরু তোয়ামার হস্তক্ষেপে সেই বেকারির মালিকপক্ষের সঙ্গে আলাপ হয় রাসবিহারী বসুর । এলাকার স্বনামধন্য সোমা পরিবার । তাদের সহায়তায় বেকারির ঠিক পিছনে পরিত্যক্ত একটি স্টুডিয়োয় আশ্রয় নেন রাসবিহারী বসু । সঙ্গী আরেক বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত ।

Ras Behari Bose
INA-তে রাসবিহারী বসু ৷ ছবি সৌজন্যে: nakamuraya.co.jp

তারপর সময় যত এগিয়েছে আরও ঘটনাবহুল হয়েছে রাসবিহারীর জীবন । ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে নাকামুরায়া বেকারির মালিক কোক্কো ও সোমা পরিবারের সঙ্গে । কোক্কোর বড়মেয়ে তোশিকোর সঙ্গে আলাপ হয়েছে । শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী । 1916 থেকে আরও বছর দুই জাপানের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন রাসবিহারী । রাজনৈতিক নানা কারণে ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি থেকে তখনও অব্যাহতি পাননি । গোয়েন্দারা লেগে রয়েছে পিছনে । এরমধ্যেই মিতসুরু তোয়ামা কথাটা একদিন পেড়েই ফেললেন সোমা দম্পতির কাছে । প্রস্তাব দিলেন রাসবিহারী-তোশিকোর বিয়ের । শুরুতে নাকি মত দেননি রাসবিহারী বসু । প্রস্তাব শুনে উত্তর আসতে দেরি হয়েছিল তোশিকোর কাছ থেকেও । তবে শেষমেশ চারহাত এক হয়েই যায় । 1918-র 9 জুলাই । তোশিকো সোমা থেকে তোশিকো বসু । প্রেম শুরু । গাঢ় হতে লাগল সে প্রেম ।

তারপরও যে থিতু হয়েছিল তাঁদের জীবন, তেমনটা নয় । গোয়েন্দা তাড়া খেয়ে বাস পালটাতে হয়েছে অনেকবার । তোশিকোর শারীরিক অবস্থাও বেগ দিয়েছে নবদম্পতিকে । দ্বন্দ্ব-দোটানার মাঝেই 1920 ও 1922 সালে তোশিকোর কোলে এসেছে তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে । আর তার ঠিক তিনবছর পর প্রেমের বাঁধন ছিঁড়ে রাসবিহারী বসুকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন তোশিকো । নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে । মাত্র 28 বছর বয়সে ।

গভীর দুঃখ গ্রাস করে রাসবিহারী বসুকে । কিন্তু তাকে কার্যত দৃঢ় লড়াইয়ে পরিবর্তিত করে ফেলেন তিনি । আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন । তৈরি করেন ইন্ডিয়ান ক্লাব । বিপ্লবী নানা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেন, নাকামুরায়া বেকারির উপরে খুলবেন ছোট্ট রেস্তরাঁ । সাহায্য করবেন শ্বশুরকে । আর তাঁর রেস্তরাঁয় মিলবে ভারতীয় ভাত-তরকারি । রেস্তরাঁর সেই ইন্দো-কারির রেসিপিতে নাকি তাঁর বিশেষ নজর থাকত । তিনি চাইতেন, এশিয়ার অন্যান্য দেশের মানুষ ভারতের স্বাদ-সংস্কৃতির মিষ্টত্ব সম্পর্কে জানুক । 1927 সাল থেকে নাকামুরায়ার মেনুতে ইন্দো-কারি থাকতে শুরু করে । খুব তাড়াতাড়ি খাদ্যরসিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে যায় সেই পদ ।

ততদিনে বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও উল্লেখযোগ্য মোড় নিয়েছে । 1942 সালে তৈরি করেছেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তৈরি করে ফেলেছেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি । পরে 1943 সালের মে মাসে বার্লিন থেকে জাপানে আসেন আরেক বরেণ্য বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু । দু'জনের সাক্ষাৎ । মাসখানেক পরে প্রিয় সুভাষচন্দ্রের হাতে INA-র দায়িত্ব তুলে দেন রাসবিহারী বসু ।

স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে । 1944 সালে ফুসফুসের সমস্যায় কাহিল হয়ে পড়েন । 1945 সালের 21 জানুয়ারি 58 বছর বয়সে ভারতমাতার অন্যতম এই বীর সন্তানের মৃত্যু হয় । শোনা যায়, যখন তিনি হাসপাতালে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন, ডাক্তার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁর খেতে ইচ্ছে করছে কি না । রাসবিহারী বসুর উত্তর ছিল, “কেন খেতে ইচ্ছে করবে ! আমি যা সবথেকে খেতে ভালোবাসি, নার্সরা তো তা আমায় দেয় না ।” ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী সেই খাবার? রাসবিহারী বসুর উত্তর নাকি ছিল, “নাকামুরায়ার ভারতীয় কারি ।”

সেই ইন্দো-কারি আজও সমান জনপ্রিয় টোকিয়োয় । বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, 2001 সাল থেকে রাসবিহারী বসুর সেই রেসিপি রেডি-টু-ইট হিসেবেও বিক্রি করা হয় এখন । নাকামুরায়া প্রসেসড ফুড ডিভিশন তৈরি হয়েছে 2016 সালে । আর হ্যাঁ, রেস্তরাঁয় গেলেই গ্রাহকরা দেখতে পান ধুতি পরিহিত রাসবিহারী বসুর ছবি । পাশে বসে আছেন কিমোনো পরিহিত তাঁর স্ত্রী তোশিকো ।

Last Updated : May 25, 2020, 7:35 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.