কলকাতা, 11 সেপ্টেম্বর : জীবন একটাই । বাঁচতে শিখুন । নিজেকে শেষ করে ফেললে, মরে গেলে তো কিছুই আর দেখতে পাবেন না । অবসাদে ভুগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন । কেন মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে? কমবয়সিদের ক্ষেত্রে মূলত কী কী সমস্যা হয়? বয়স্কদের ক্ষেত্রেই-বা আত্মহত্যার কারণ কী হতে পারে? প্রতিরোধ কীভাবে সম্ভব? এমন বিভিন্ন বিষয়ে বলেছেন কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডাক্তার শর্মিলা সরকার ।
আত্মহত্যার প্রবণতা আগের থেকে অনেক বেড়ে গিয়েছে । সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, প্রত্যেক বছর বিশ্বে 10 লাখ মানুষ আত্মহত্যা করছেন । যাঁরা আত্মহত্যা করছেন তাঁদের মধ্যে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি । 45 বছর বা তার থেকে বেশি বয়স যাঁদের, তাঁদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে । যাঁরা আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন তাঁদের মধ্যে কমবয়সিদের সংখ্যা বেশি ।
ডাক্তার শর্মিলা সরকার বলেন, "আত্মহত্যার কারণ হিসাবে কিছু কিছু কারণ চিহ্নিত করা যায় । তার চিকিৎসা আছে । কিন্তু কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করা যায় না । বয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি । ফ্যামিলিতে আত্মহত্যার ঘটনা থাকলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা দেয় । মানসিক কোনও সমস্যা বা ডিপ্রেশনও কারণ হতে পারে । অ্যালকোহল খেলে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেশি থাকে । অনেক সময় দেখা যায় যে, আত্মহত্যা করার আগে অনেক রকম নেশা করে নিয়েছিল, তারপরে আত্মহত্যা করেছে । বা কিছুদিন ধরে নেশার পরিমাণটা বাড়িয়ে দিয়েছিল । তারপরে আত্মহত্যা করেছে । এগুলি এক একটি রিস্ক ফ্যাক্টর । ইমিডিয়েট কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে । যেমন, কিছু ক্ষতি হল । কারও সঙ্গে ঝগড়া বা কিছু একটা হল । বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড ঘটিত কোনও ব্যাপার দেখা দিল । বয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা গেল স্বামী বা স্ত্রী মারা গেল বা কাছের কোনও বন্ধু মারা গেল বা অর্থনৈতিক কোনও সমস্যা দেখা দিল । আচমকা এমন কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যায় ।"
অল্পবয়সিদের মধ্যে কেন আত্মহত্যার চেষ্টা বেশি দেখা যায়? ডাক্তার শর্মিলা সরকার বলেন, "ছোটদের মধ্যে এখন প্রেশারটা বেশি । আগেও ছিল । কিন্তু এখন সোশ্যাল বা পি আর প্রেশারটাও চলে আসছে । সোশ্যাল মিডিয়ার কথা বলতে পারি । সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ভাল দিকগুলি হাইলাইট করি । কোথাও ঘুরতে গিয়েছি, রেস্তরাঁয় খাচ্ছি, খুব খুশিতে আছি, এগুলো বেশি করে দেখানো হয় । নেগেটিভ দিকগুলো কম দেখানো হয় । যে মানুষটি খারাপ অবস্থায় রয়েছে, কোনও একটা সমস্যায় রয়েছে, সে যখন অন্য কাউকে দেখে এত ভালো আছে আর সে ভালো থাকতে পারছে না, তখন সে আচমকা কিছু একটা করে ফেলে । হঠাৎ করে কিছু একটা করার প্রবণতা বাড়ে । আজকাল যেটা হচ্ছে, মা-বাবার একটি মাত্র সন্তান । ছোটবেলা থেকে খুব বেশি প্যাম্পারড । যা চাইছে তাই দিচ্ছে । তারা না শুনতে শেখেনি কোনও দিন । মানে এটা চাইলে, তুমি এটা পাবে না, এটা শুনতে শেখেনি কোনও দিন । এবার বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থায় গিয়ে যখন কোনও কিছুতে না শুনছে, বা দেখছে কোনও একটি বিষয় তাকে দেওয়া হচ্ছে না । তখন হঠাৎ করে কিছু একটা করে ফেলে । বিষয়টা এমন যে, দেখো দেবে না, হাতটা আমি কেটে ফেললাম । মা-বাবা এটা দেখলে নিশ্চয়ই আমাকে দিয়ে দেবে । সন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা যদি তেমন না থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করার প্রবণতা চলে আসে ।"
আত্মহত্যার সিম্পটমস কিছু আছে ? আগে থেকে বোঝা যায় দেখে? ডাক্তার শর্মিলা সরকার বলেন, "অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে কিছু বলা সম্ভব না । তবে টেম্পারমেন্ট বলি আমরা । ওদের পার্সোনালিটি ডেভেলপ তখন করে না । তবে কিছু কিছু বিষয় দেখে বোঝা যায় । যেমন, একবার করলে বার বার করতে থাকা । হঠাৎ করে কিছু একটা করার প্রবণতা । যেমন, একটু বকা হল, ব্যাস খাওয়া বন্ধ করে দিল । বা ঘরে থাকলে দরজা বন্ধ করে দিল । বা অকারণে কেঁদে ফেলছে, খুব বেশি রিঅ্যাক্ট করছে, উত্তেজিত হয়ে পড়ছে । অন্য একটি বিষয় হচ্ছে, যদি ডিপ্রেশন চলে আসে । মন খারাপ, একা একা হয়ে গেছে, কিছু ভালো লাগছে না, তার কিছু করতে ইচ্ছা করছে না, মনে রাখতে পারছে না , পড়তে পারছে না । এরকম যদি ডিপ্রেশন চলে আসে তাহলে আত্মহত্যার চেষ্টা করার প্রবণতা চলে আসে ।"
ডাক্তার শর্মিলা সরকার বলেন, "মাঝবয়সি বা বয়স্ক যারা, তাদের ক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে । সোশালি যদি ঠিকঠাক জায়গায় রাখি আমি, যেমন সবার সঙ্গে কথা বলা , এগুলি কিছু প্রোটেক্টিভ ফ্যাক্টর আমরা বলি । যেটা মানুষকে সাহায্য করে একটুখানি বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে । যেমন যদি লোকজনের সঙ্গে বেশি করে কথা বলা যায় । বাড়ির লোকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকে । বন্ধুদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারি । এক্ষেত্রে আত্মহত্যা করার প্রবণতা একটু কম থাকে । কিছু কিছু অসুখ রয়েছে, যেমন ডিপ্রেশন । বেশি বয়সে চলে আসে । বেশি পরিমাণে যদি নেশা করে বা স্কিৎসোফ্রেনিয়া জাতীয় অসুখ, অ্যাংজাইটি বেশি থাকে । এসব ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায় । যদি ডিপ্রেশন আসে, ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে এখন তাঁর আর কিছু করার নেই । বা স্বামী অথবা স্ত্রীর মধ্যে কেউ একজন বেঁচে নেই, তার আর বেঁচে থেকে কী হবে । এক্ষেত্রে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায় ।"
টিনেজারদের ক্ষেত্রে?
ডাক্তার শর্মিলা সরকার বলেন, "এদের ক্ষেত্রে রিলেশনশিপ প্রবলেম একটা হুট করে চলে এল । এরা বেশি ইম্পালসিভ ওয়েতে করে । প্ল্যান করে করে না । হঠাৎ করে ফেলল । বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে যারা কমপ্লিটেড আত্মহত্যা করেন, এক্ষেত্রে যেটা হয় অনেকদিন ধরে প্ল্যান করেন তারা । অনেক ক্ষেত্রে ইম্পালসিভ ওয়েতে করে ফেলতে পারে । আবার এমনও হয়, এই সব সিম্পটমস দেখে বাড়ির লোকেরাও কিছুটা বুঝতে পারবে, অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় কিছুদিন ধরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে । হঠাৎ করে নিজেকে সবার কাছ থেকে গুটিয়ে রাখা । কারও সঙ্গে মিশছে না । বারবার করে আত্মহত্যার কথা বলছে । কিছু ভালো লাগছে না, বেঁচে থেকে কী হবে, জীবন সম্পর্কে হতাশা, তার হয়তো আর কিছু হবে না । কোনও কিছু ক্ষতি হলে, সেই জায়গা থেকে তিনি আর ফিরে আসতে পারবেন না এমন ভাবনা । কিছুদিন ধরে হয়তো কোনও ওষুধ জোগাড় করছে বা দড়ি, কোনও অস্ত্র, যেগুলো দিয়ে আত্মহত্যা করে, সেগুলো কিছু জোগাড় করছে । বাড়ির লোক একটু সতর্ক থাকলে এগুলো বুঝতে পারবেন ।"
প্রতিরোধ কি সম্ভব, কীভাবে?
ডাক্তার শর্মিলা সরকার বলেন, "প্রতিরোধ সেই হিসাবে 100 শতাংশ কোনও ভাবে সম্ভব নয় । কোনও মানুষ যদি ভেবে থাকেন তিনি আত্মহত্যা করবেন, কোনও ভাবে যদি তিনি প্রকাশ না করেন, তা হলে তাঁকে বাঁচানো যায় না । কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আছে, এক্ষেত্রে কিন্তু আগে বোঝা সম্ভব । ডিপ্রেশন থাকলে বলে তার ভাল লাগছে না বা অন্য কিছু ।"
ডাক্তার শর্মিলা সরকার বলেন, "ফেসবুকে লাইভ স্ট্রিমিং করে আত্মহত্যা করার চেষ্টা অল্পবয়সিদের মধ্যে বেশি দেখা যায় । তার হয়তো কোনও সমস্যা হয়েছে, কাউকে বলেছে আত্মহত্যা করবে, কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি । লাইভ স্ট্রিমিং যদি করা হয় তাহলে সেও দেখবে অন্য অনেকে দেখবে যে কীভাবে আত্মহত্যার সময় কষ্ট পাচ্ছে । যদিও মরে যাচ্ছে, কিন্তু এভাবেও কোথাও একটা প্রচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে । আর একটা বিষয় থাকে, যেটা হল তার কষ্টটাকে জানানো । লাইভ স্ট্রিমিং করে তা দেখিয়ে দিয়ে গেল সে । এটা দেখেও অনেকে আছে যারা অনুকরণ করে ।"
কাছের মানুষ কীভাবে সাহায্য করতে পারেন?
ডাক্তার শর্মিলা সরকার বলেন, "যদি বলে, তা হলে কাছের মানুষ অনেক রকম ভাবে হেল্প করতে পারেন । ভালো কাউন্সেলিং যদি করতে পারে কাছের মানুষ বা কীভাবে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে, সেটা যদি কাছের মানুষ ভালো বোঝে, তা হলে আত্মহত্যার ইচ্ছা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে । কোনও একটি বিষয় হচ্ছে, যিনি আত্মহত্যা করতে চাইছেন, তাকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া । আমি বলছি, তোর কিছু হবে না, কাছের মানুষের এরকম বক্তব্য দিয়ে সবসময় হয় না । তিনি আত্মহত্যা করতে চাইছেন তাঁর হতাশা, তাঁর মনের মধ্যে অনেক কষ্ট চলছে, যদি তিনি মনে করেন, কোনও একটি অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার তাঁর উপায় নেই, এ ক্ষেত্রে কিন্তু আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা বেশি থাকে । এক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে আসা জরুরি । কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলো দিলে আত্মহত্যা করার প্রবণতা কমে যায় । এর সঙ্গে অন্য চিকিৎসা করা হয় । যে কারণে তার মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে সেই সব কারণের জন্য ।"
জীবন একটাই । বাঁচতে শিখুন । শেষ করে ফেললে মরে গেলে তো কিছু আর দেখতে পাবেন না । জীবনের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে রয়েছে । ভালো-মন্দ সবকিছু রয়েছে । রাতের পরে দিন আসে । খারাপ কিছু একটা ঘটলে সব সময় সেটা স্থায়ী নয় । আবার ভালো কিছু ঘটবে । সুতরাং সেই আশা রাখা উচিত । আর যদি কোনও সময় কোনও সমস্যা হয়, মানসিক কোনও সমস্যা হয়, তাহলে কাউন্সেলিং করুন ।