কলকাতা, ২৯ জুলাই: গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন হুগলির চণ্ডীতলার এক যুবতি ৷ কিন্তু, টের পাননি ৷ কারণ বন্ধ হয়নি ঋতুস্রাব ৷ তবে পেটে ব্যথা করত ৷ তাই তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ সেখান থেকে রেফার করা হয় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ৷ সেখানেই অস্ত্রোপচার করে তাঁর পেট থেকে মৃত অবস্থায় বের করা হয় গর্ভস্থ সন্তানকে । জরায়ু ফেটে যা বেরিয়ে গেছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা ৷ অস্ত্রোপচার করা না হলে ওই যুবতির মৃত্যু হতে পারত বলেও জানিয়েছেন তাঁরা ৷
বছর পঁচিশের শ্রীতমা (নাম পরিবর্তিত) বাগ হুগলি চণ্ডীতলার বাসিন্দা । গত বৃহস্পতিবার তাঁকে নিয়ে আসা হয় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় হাসপাতালের আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট । সেখানে বলা হয়েছিল, জরায়ুর বাইরে পেটের মধ্যে তাঁর গর্ভস্থ সন্তান রয়েছে । কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক তপনকুমার নস্কর বলেন, "এটাকে আমরা বলি অ্যাবডোমিনাল প্রেগনেন্সি । সাধারণত গর্ভস্থ সন্তান জরায়ুতে থাকার কথা । এক্ষেত্রে জরায়ুতে না থেকে গর্ভস্থ সন্তান আছে জরায়ুর বাইরে৷ পেটের মধ্য ।" এই ধরনের ঘটনা কি বিরল? এই প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসক বলেন, "অবশ্যই । এই ধরনের ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না ।" চিকিৎসক বলেন, "পেটে ব্যথা, ভালো লাগছে না, শরীর খারাপ, এমন সমস্যা নিয়ে রোগী এসেছিলেন বহির্বিভাগে । আমরা জানতে চেয়েছিলাম তাঁর ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছে কি না । বলেছিলেন, বন্ধ হয়নি । পেটটা কেমন ফোলা ফোলা লাগছে, পেটে ব্যথা হচ্ছে ।"
এর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন চিকিৎসকরা । ওই যুবতি গর্ভবতী কি না তা জানার জন্য ইউরিন টেস্ট করা হয় । চিকিৎসক তপনকুমার নস্কর বলেন, "ইউরিন টেস্টের রিপোর্টে দেখা যায় তিনি গর্ভবতী নন । তবে, তাঁর পেটের মধ্যে কিছু একটা রয়েছে তা আমরা বুঝতে পারছিলাম । তাঁর সঙ্গে থাকা আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্টে অ্যাবডোমিনাল প্রেগনেন্সির কথা বলা হয়েছে ।" এর পর ওই যুবতিকে ভরতি করা হয় । বোঝা যায় শরীরে রক্ত কম রয়েছে । এর পর আবারও আলট্রাসোনোগ্রাফি করানো হয় । রিপোর্টে জানা যায়, গর্ভস্থ সন্তান পেটের মধ্যে রয়েছে । কিন্তু, জরায়ুতে কিছু গন্ডগোল রয়েছে । তবে এর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও চিকিৎসকরা বুঝতে পারছিলেন না, গর্ভস্থ সন্তান কোথায় রয়েছে । রক্ত দিয়ে রোগীর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল করানো হয় । CT স্ক্যান করানো হয় । স্ক্যানের রিপোর্টেও বলা হয়, এই রোগীর পেটের মধ্য গর্ভস্থ সন্তান রয়েছে । এর পর শনিবার অস্ত্রোপচার করা হয় ।
চিকিৎসক তপনকুমার নস্কর বলেন, "অস্ত্রোপচারের সময় আমরা দেখি, এই রোগীর পেটের মধ্যে পুরোনো রক্ত জমে রয়েছে এবং গর্ভস্থ সন্তান খাদ্যনালীর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ।" চিকিৎসক আরও বলেন, "রোগীর জরায়ুর দুটি চেম্বার বা প্রকোষ্ঠ রয়েছে । একটি স্বাভাবিক এবং, অন্যটি ছোটো । গর্ভস্থ সন্তানের নাড়ি ধরে এগিয়ে যেতে যেতে আমরা দেখি, ফুল অর্থাৎ, প্লাসেন্টা আটকে রয়েছে জরায়ুর ওই ছোটো প্রকোষ্ঠের মধ্যে ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "আসলে ওই যুবতি গর্ভবতী হয়েছিলেন জরায়ুর ওই ছোটো প্রকোষ্ঠে । প্রকোষ্ঠটি ছোটো হওয়ায় গর্ভস্থ সন্তান বেড়ে ওঠার সময় সেখানে আর জায়গা পায়নি । এর ফলে, জরায়ুর ছোটো এই প্রকোষ্ঠ ফেটে পেটের মধ্যে চলে আসে রোগীর গর্ভস্থ সন্তান ।" তিনি বলেন, "ওই যুবতি কিছু বুঝতেই পারেননি । তিনি জানেনও না যে, তিনি কবে গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন । জরায়ুর এই ছোটো প্রকোষ্ঠ ফেটে যাওয়ার পরও এই রোগী কিছু বুঝতে পারেনি ।" দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠের বিষয়ে তিনি বলেন, "এটা খুব স্বাভাবিক নয় ।"
যদিও জরায়ুর বাইরে গর্ভস্থ সন্তান থাকলে, সে বেঁচেও থাকতে পারে । এই কথা জানিয়ে চিকিৎসক তপনকুমার নস্কর বলেন, "যদি দেখা যায় লিভার বা খাদ্যনালীর সঙ্গে প্লাসেন্টা যুক্ত রয়েছে সেই ক্ষেত্রে জরায়ুর বাইরে থাকলেও গর্ভস্থ সন্তান বেঁচে থাকতে পারে । কারণ প্লাসেন্টা তখন লিভার বা খাদ্যনালী থেকে রক্ত সঞ্চালন জোগাড় করতে পারে । খাবার বা পুষ্টি জোগাড় করতে পারে ।" তবে শুধুমাত্র গর্ভে বেঁচে থাকাও নয় । এই চিকিৎসক বলেন, "মেডিকেল হিস্ট্রিতে রয়েছে এমন গর্ভস্থ সন্তানকে সিজ়ারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে জন্মও দেওয়া হয়েছে ।" রোগীর সঙ্গে থাকা ওই আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্টে মৃত গর্ভস্থ সন্তানের কথা বলা হয়েছিল । এ কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, "এই রিপোর্ট দেখে আমরা ভেবেছিলাম গর্ভস্থ সন্তানের প্লাসেন্টা পেটের মধ্যে রয়েছে । এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার আলট্রাসোনোগ্রাফি করানো হয় । CT স্ক্যান করানো হয় । এ সব রিপোর্ট পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারেনি । অস্ত্রোপচার করার সময় আমরা বুঝতে পারলাম যে, জরায়ুর ওই ছোটো প্রকোষ্ঠে গর্ভস্থ সন্তান বেড়ে উঠছিল ।"
জরায়ুর এমন দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ কেন হতে পারে ? এই চিকিৎসক বলেন, "জরায়ু যখন তৈরি হয়, তখন ডেভেলপমেন্টাল অ্যাবনরম্যালিটিস থাকে । দু' দিক থেকে ছোটো ছোটো প্রকোষ্ঠ মাঝখানে এসে একসঙ্গে একটি প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়ে যায় । কোনও কারণে এই রোগীর ক্ষেত্রে জরায়ুর দুই দিকের প্রকোষ্ঠ একসঙ্গে হতে পারেনি । এর ফলে দু'টি আলাদা প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়েছে । একটি বড়, একটি ছোটো প্রকোষ্ঠ । এই ছোটো প্রকোষ্ঠে গর্ভস্থ এই সন্তানের জন্ম হয়েছে । সেখানে বৃদ্ধির জায়গা না পেয়ে প্রকোষ্ঠটি ফেটে গর্ভস্থ সন্তান পেটের মধ্যে চলে গেছে ।"
পেটের মধ্যে গর্ভস্থ সন্তান এ ভাবে চলে যাওয়ার কারণে কেন সে আর বাঁচতে পারল না? চিকিৎসক বলেন, "সাধারণত গর্ভস্থ সন্তান যে জলের মধ্যে ভেসে থাকে, জরায়ুর ছোটো প্রকোষ্ঠ ফেটে যাওয়ার জন্য সেই জল বেরিয়ে গেছে । ওই ছোটো প্রকোষ্ঠে প্লাসেন্টা যে জায়গায় লেগে ছিল, সেই জায়গা থেকে সরে গেছে । এর ফলে রক্ত সঞ্চালন হচ্ছিল না, খাবার পাচ্ছিল না এই গর্ভস্থ সন্তান । এই কারণে এই গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হয়েছে । আমাদের এখানে আসার সপ্তাহ খানেক আগে এই গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে ।"
একই সঙ্গে এই চিকিৎসক বলেন, "প্লাসেন্টা যখন লিভার বা খাদ্যনালীর উপরে জন্মায়, তখন সেখান থেকে রক্ত সঞ্চালন ঘটে এবং খাবার বা পুষ্টি সেখান থেকে পায় । এর ফলে, ধীরে ধীরে গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি হতে থাকে ।" যেভাবে এক্ষেত্রে জরায়ুর একটি প্রকোষ্ঠ ফেটে গর্ভস্থ সন্তান বেরিয়ে গিয়েছিল পেটের মধ্যে ৷ তাতে ঝুঁকি কতটা ছিল? চিকিৎসক তপনকুমার নস্কর বলেন, "এই যে জরায়ুর ছোটো প্রকোষ্ঠ ফেটে বেরিয়ে গেছে গর্ভস্থ সন্তান, এক্ষেত্রে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় । অস্ত্রোপচার করে এই রক্তক্ষরণ যদি বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তা হলে প্রসূতির মৃত্যু হতে পারে । গর্ভস্থ সন্তান পেটের মধ্যে এভাবে থাকার কারণে খাদ্যনালী এবং লিভারের সংযোগ ঘটিয়ে, খাদ্যনালীতে সমস্যা তৈরি করতে পারে, পচন ধরতে পারে । এর ফলে সেপটিসেমিয়ার কারণে রোগীর মৃত্যু হতে পারে ।"