কলকাতা, 25 মে : পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে পড়ুয়াদের । প্রথমে কোরোনার সংক্রমণের জেরে প্রথাগত ক্লাসরুম শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতি । তবু, অনলাইনের পঠন-পাঠন ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বার্তা পৌঁছে যাচ্ছিল পড়ুয়াদের কাছে । কিন্তু, সম্প্রতি আমফান ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিষেবা বিভ্রাটে এবার ফের বন্ধ হয়ে গেল অনলাইন পঠন-পাঠন ব্যবস্থা ।
কোরোনা সংক্রমণের জেরে 16 মার্চ থেকে বন্ধ রাজ্যের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । বন্ধ থাকার কথা 10 জুন পর্যন্ত । প্রায় তিন মাস স্কুল বন্ধ থাকায় ক্লাসরুম শিক্ষা ব্যবস্থা আগেই বিঘ্নিত হয়েছিল । ক্লাসরুম পঠন-পাঠনের বিকল্প হিসেবে অনলাইন পঠন-পাঠন ব্যবস্থা বেছে নিয়েছিল রাজ্য সরকারি ও বেসরকারি স্কুলগুলি । কোথাও স্কুল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে, আবার কোথাও কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকার উদ্যোগে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের মতো সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ও অনলাইন ক্লাস নেওয়ার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে লকডাউনের পর থেকেই অনলাইন পঠন-পাঠন চলছিল । কিন্তু, এবার আমফান ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বিঘ্নিত হল অনলাইন পঠন-পাঠন ব্যবস্থাও ।ড20 মে আমফান ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে দক্ষিণবঙ্গে । প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন রাজ্যে । ছয় দিন পার হয়ে গেলেও এখনও বহু জায়গায় বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক হয়নি । স্বাভাবিক হয়নি মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট পরিষেবাও । বিদ্যুৎ না থাকায় স্মার্ট গেজেট চার্জ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না । আবার বিদ্যুৎ পরিষেবা থাকলেও মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকায় পড়ুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না । তাই যতদিন না এই পরিষেবাগুলি স্বাভাবিক হচ্ছে ততদিন অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থাও স্বাভাবিক হবে না বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল ।
কলকাতার শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গভঃ গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া নাগ বলেন, "অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ নেই । গাছপালা পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে । ইন্টারনেটও নেই । অনেকে মোবাইলে চার্জ দিতে পারছে না, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে না । ফলে, আমফান পরবর্তী চার-পাঁচদিন অনলাইন পঠন-পাঠন ব্যবস্থা একটু বিঘ্নিত হয়েছে । চার-পাঁচদিন পর থেকে যে সব এলাকায় বিদ্যুৎ আছে, ইন্টারনেট আছে সেই সব এলাকার মেয়েরা যোগাযোগ করতে পারছে । সেই সংখ্যাটাও খুবই কম । তিন-চারদিন তো কিছুই হয়নি । তারপর আরও তিন-চারদিন সময় লাগবে সব ঠিক হতে । তারপরে আবার আগের মতো শুরু করব ।" বাগবাজার মাল্টিপারপাস গার্লস হাই স্কুলের কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষিকা পরমা মাঝি বলেন, "আমাদের প্রধান শিক্ষিকা এক সপ্তাহের জন্য ক্লাস বন্ধ রাখার জন্য বলেছেন । কারণ, এখন অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই । সেখানকার পড়ুয়ারা ক্লাস করবেন কী করে বা শিক্ষিকারা ক্লাস নেবেন কী করে । তাই আপাতত এক সপ্তাহের জন্য অনলাইন ক্লাস বন্ধ রাখা হয়েছে আমফানের পরদিন থেকেই ।"
দক্ষিণ 24 পরগনার গোবিন্দরামপুর অশ্বিনীকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক সুব্রত দাস বলেন, "আমরা কয়েকজন শিক্ষক উদ্যোগ নিয়ে নবম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির অনলাইন ক্লাস নিচ্ছিলাম । আমরা ক্লাস করিয়েছি ঠিকই । কিন্তু, 100 শতাংশ পড়ুয়াদের পাইনি । গ্রামের দিকে বিভিন্ন দরিদ্র পড়ুয়া রয়েছে, যাদের স্মার্টফোন নেই । আবার স্মার্টফোন থাকলেও ইন্টারনেট রিচার্জ করানোর মতো আর্থিক অবস্থা নেই । ফলে, আমরা 25-30 শতাংশ পড়ুয়া পেতাম অনলাইন ক্লাসে । এখন সেটাও দিতে পারছি না । এখন আমাদের এখানে আমফানের কারণে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়ে গেছে বলব । বেশিরভাগ জায়গাই বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে । ফলে, নেটওয়ার্ক এসে গেলেও মোবাইল চার্জ দেওয়ায় সমস্যার কারণে অনলাইন পঠন-পাঠন ভীষণভাবে বিঘ্নিত । একেবারেই বাধাপ্রাপ্ত । শুরুই করা যাচ্ছে না । ফলে, আপাতত অনলাইন পঠন-পাঠন থমকে গেল ।"
যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্য বলেন, "অনলাইন পঠন-পাঠন তো ব্যাহত একটু হয়েছে । 20 মে থেকে প্রথম দু-তিনদিন খুব অসুবিধা হয়েছে । আমরা কোনও কাজই করতে পারিনি । অনেক পড়ুয়ারাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ঝড়ে । তাঁরা কান্নাকাটি করছে । দু-তিনদিন পর যে সব শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে সেই সময়টা ওই শিক্ষকদের কাজে লাগিয়ে কিছুটা কাজ করতে পেরেছি । এখন তো অনলাইন ক্লাস সম্ভব নয় । তাই আমি বলেছি, অডিয়ো করে বাচ্চাদের দিয়ে দিতে । তাতে তাঁরা এখন না পারলেও পরে শুনে নিতে পারবে । পরিষেবা ব্যাহত হলেও তার মধ্যে যতটা পড়ুয়াদের পড়াশোনা করানো যায় সেই চেষ্টা করছি । এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলেছি, মেটেরিয়াল তৈরি করে রাখতে । যাতে পরিষেবা স্বাভাবিক হলেই তা পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় ।"
এভাবেই আমফান ঝড়ে প্রভাবিত জেলাগুলিতে অনলাইন পঠন-পাঠন ব্যবস্থা হোঁচট খেয়েছে । শুধু সরকারি, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত নয়, যে সব বেসরকারি স্কুলগুলিতে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস হচ্ছিল তাও থমকে গেছে কিছুদিনের জন্য । দিল্লি পাবলিক স্কুল রুবি পার্কের জনসংযোগ আধিকারিক জানান, 16 মে থেকে 25 মে পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হয়েছিল । 26 মে থেকে আবার অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু, আমফানের জেরে বহু জায়গায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিষেবা না থাকায় 1 জুন থেকে ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । শ্রী শিক্ষায়তন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সঙ্গীতা ট্যান্ডন বলেন, "প্রথমদিকে পড়ুয়া, শিক্ষকদের উপর প্রভাব পড়েছিল । দু-তিনদিন পর থেকে আস্তে আস্তে সব ঠিক হচ্ছে । আশা করছি আর কয়েকদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে । ইন্টারনেট নেই বেশ কিছু জায়গায় । তার জন্য সমস্যা হচ্ছিল । তবে, আজ থেকে আমাদের গরমের ছুটি শুরু হয়েছে । যতদিনে আবার অনলাইন ক্লাস শুরু হবে ততদিন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে করছি ।" কিছুদিনের মধ্যে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিষেবা স্বাভাবিক হয়ে গেলে আবার আগের মতো অনলাইন পঠন-পাঠন ব্যবস্থা চালু করা যাবে বলে মনে করছেন অনেকে ।