কলকাতা, 8 মে : সুস্থ কিন্তু থাকার উপযুক্ত জায়গা নেই । তাই সরকারি নথিতে তাঁরা এখনও মানসিক হাসপাতালের রোগী । এই রোগীদেরই ভোটার লিস্টে নাম ওঠানোর জন্য হিমশিম খেতে হল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে । তাঁদের ভোটাধিকার দিয়ে কী হবে? তাঁদের মতামতের কি সত্যিই কোনও গুরুত্ব রয়েছে? এমনই সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে সংগঠন ও কর্তৃপক্ষকে । যদিও সফল হয়েছে প্রচেষ্টা । আর তাই উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে এবার ভোটদানের জন্য প্রস্তুত ক্যালকাটা পাভলভ হসপিটালের ৫৪ জন রোগী । ভোটাধিকার পেয়েছেন বহরমপুরের সরকারি মানসিক হাসপাতালেরও ৬৫ জন ।
পাভলভে চিকিৎসার জন্য ভরতি হয়েছিলেন রতন রায়নন্দী । বাড়ি বেলঘড়িয়ায় । ব্যবসা করতেন । বাড়িতে মা ও ভাই রয়েছেন । রতনবাবুর স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকেন । ১২ বছর ধরে হাসপাতালে রয়েছেন তিনি । বাড়ির লোক আগে দেখা করতে আসত । এখন আর আসে না । রতনবাবুর নিজেরও এখন বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে না । তাঁর নাম এবার ভোটার লিস্টে উঠেছে । তিনি বলেন, "ভোট নিজের অধিকার । ১২ বছর পরে আবার ভোট দিচ্ছি । সুস্থ হয়েছি । আমাদের ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে । খুব আনন্দ হচ্ছে । কাকে ভোট দেব সেটাও ঠিক করে নিয়েছি ।"
ভোটার লিস্টে নাম উঠেছে মৌসুমী মুখোপাধ্যায়ের । বাড়িতে তাঁর স্বামী ও মেয়ে রয়েছে । বাপের বাড়ি বসিরহাটে । বিয়ের পর থাকতেন মুম্বইতে । আট বছর ধরে এই হাসপাতালে রয়েছেন তিনি । ভোট দিতে পারবেন জেনে খুশি । কিন্তু পরিবারের কেউ না আসায় আক্ষেপও রয়েছে । মৌসুমি বলেন, "বাড়ির লোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে না । হয়তো আমি এখানে আছি সেটা জানে না । তবে, দিদি-জামাইবাবু আমাকে দেখতে এসেছিলেন বছরখানেক আগে । বাড়ি ফিরতে খুব ইচ্ছা করে । কিন্তু উপায় নেই।" ভোট দেওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, "ভোট দেওয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার পেতে চাই । আমাদের জন্য সরকার যাতে আরও সুযোগ-সুবিধা দেয় তার জন্য ভোট দেব।"
পাভলভে এই ৫৪ জনের ভোটার লিস্টে নাম উঠেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চেষ্টায় । ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সিনিয়র প্রোজেক্ট ম্যানেজার শুক্লা দাস বড়ুয়া বলেন, "এই হাসপাতালের ৫৪ জনের জন্য ভোটার কার্ড তৈরি হয়েছে । বহরমপুর মেন্টাল হাসপাতালে ভোটার কার্ড পেয়েছেন ৬৫ জন । ভোটাধিকার মানে একজন মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া । এখানে বহু মানুষ রয়েছেন যারা সুস্থ । এই মুহূর্তে বাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা নেই বা পরিস্থিতি নেই । তার মানে কি তাঁরা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন? ভোটাধিকার একটি মানুষের প্রাথমিক অধিকারের মধ্যে পড়ে । সেজন্য আমাদের মনে হয়েছিল, ভোটাধিকার নেই বলে সরকার এদের দিকে নজর দিচ্ছে না । তাই তাঁদের ভোটাধিকারের দাবিতে আমরা লড়াইটা শুরু করেছিলাম । ওদের ভোটাধিকার পেতে দফায় দফায় নির্বাচন কমিশনে মিটিং করতে হয়েছে । স্বাস্থ্য ভবনে মিটিং করতে হয়েছে । দীর্ঘ দিনের চেষ্টার ফলে আমরা সফল হয়েছি। "
শুক্লা আরও বলেন, "পাভলভ হাসপাতালে এখন ৬৫০ জন রোগী আছে । এর মধ্যে ৪০ শতাংশ রোগীর এখন হাসপাতালে থাকার কোনও দরকার নেই । নতুন মানসিক স্বাস্থ্য আইন এসেছে । এই আইনে আগামী বছর হয়তো অনেকই বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন । বাড়িতে ফেরার পর তাঁরা নিয়মিত হাসপাতালের বহির্বিভাগে এসে চিকিৎসা করাতে পারবেন । যাদের অ্যাকিউট মেন্টাল ইলনেস রয়েছে, তাঁদেরই একমাত্র হাসপাতালে থাকার কথা ।
যাঁরা ভোটাধিকার পেয়েছেন তাঁরা সকলেই সুস্থ । আমাদের সংগঠনের বিভিন্ন ধরনের প্রোজেক্টের সঙ্গে তাঁরা এখন যুক্ত। তাঁদের কেউ কাপড় কাচেন, কেউ ক্যান্টিনে কাজ করেন । কেউ প্রিন্টিং ইউনিটে কাজ করেন । ভোটার লিস্টে নাম ওঠানোর জন্য এই ৫৪ জনের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এই হাসপাতালেরই ঠিকানা । তবে ঠিকানায় হাসপাতালের নাম লেখা হয়নি । কারণ এই হাসপাতালের নাম অনেক ক্ষেত্রে স্টিগমা হিসেবে কাজ করে ।"
পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ বলেন, "আমাদের এখানে এখন ২০০ জন সুস্থ । তাঁদের মধ্যে যাঁরা দীর্ঘদিন ওষুধ ছাড়াই সুস্থ আছেন, তাঁদের নাম ভোটার লিস্টে ওঠানোর জন্য চেষ্টা করা হয়েছে ।"