এ যেন 1957 সালের ভূতের হানা । আর যার জেরে এখন রীতিমতো বেকায়দায় তৃণমূল কংগ্রেস । 63 বছরের ‘বুড়ো ভূত’ 2020 সালের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে অস্বস্তিতে ফেলছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলকে । বিতর্কের কেন্দ্রে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র ।
আরও স্পষ্ট করে বললে, দলের অস্বস্তি এবং বিতর্কের কেন্দ্রে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র । 6 ডিসেম্বর । মহুয়া নদিয়ার গয়েশপুরে এক দলীয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন । সেখানে উপস্থিত কয়েক জন সাংবাদিকের উদ্দেশে তৃণমূল সাংসদ কিছু মন্তব্য করেন । বিতর্কের শুরু সেখান থেকেই ।
ওই দিন মহুয়া যখন বৈঠকে উপস্থিত হন, তখন দলেরই দুই গোষ্ঠির মধ্যে কার্যত সংঘর্ষ বেধে যায় । সেই সময়েরই কিছু ভিডিয়ো ফুটেজে এই সংঘর্ষের বিষয়টি সামনে আসে ।
ভিডিয়োতে দেখা যায়, দলেরই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ থামাতে যাবতীয় চেষ্টা করে চলেছেন মহুয়া । সেই সময়ই তাঁর নজর গিয়ে পড়ে সেখানে উপস্থিত কয়েক জন সাংবাদিকের উপর । তৃণমূল সাংসদ তখন তাঁদের সেখান থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলে ওঠেন, “কে এই দু’পয়সার সাংবাদিকদের এখানে ডেকে এনেছে? টিভিতে মুখ দেখাতে কিছু নেতা একটু বেশি মাত্রায় আগ্রহী বলেই মনে হচ্ছে । এখনই এখান থেকে সাংবাদিকদের বের করে দিন ।”
মহুয়ার এই মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সোশাল মিডিয়ায় । মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় তাঁর এই মন্তব্য । আর ‘জয়ের মুকুট’ ছিনিয়ে নেয় প্রায় বিস্মৃত হতে চলা দুই পয়সার কয়েন ।
1957 সালে বম্বের টাঁকশালে প্রথম তৈরি হয়েছিল এই দুই পয়সার কয়েন । তবে দুই পয়সার কয়েনের চেয়েও তা বেশি পরিচিত ছিল ‘নয়া পয়সা’ (নতুন পয়সা) নামে ।
গোলাকার ধারযুক্ত এই কয়েনগুলি প্রাথমিক ভাবে তৈরি হয়েছিল অ্যালুমিনিয়াম এবং ব্রোঞ্জের শঙ্কর ধাতু দিয়ে ।
1965 সাল থেকে এই কয়েন বানানো শুরু হয় কলকাতা টাঁকশালে । সেই সময় থেকে বদলে যায় এর উপকরণ । দুই পয়সার কয়েন তখন থেকে তৈরি হতে থাকে অ্যালুমিনিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়ামের শঙ্কর ধাতু দিয়ে ।
1980 সাল থেকে ভারত সরকার এই দুই পয়সার কয়েন তৈরি করা বন্ধ করে দেয় । 2011 সালের 30 জুন সরকার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বাজার থেকে 25 পয়সা এবং তার কম মূল্যের সব কয়েন তুলে নেওয়া হবে ।
এর পর কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর । এককালে যে কয়েনের রাজত্ব ছিল, আজকের ভারত সেই দুই পয়সার কয়েন কেমন দেখতে সেটাই ঠিক মতো মনে করতে পারে না । কিন্তু মহুয়া মিত্রের সৌজন্যে সেই আপাত বিস্মৃত কয়েন ফিরে এসেছে জনপ্রিয় হয়ে । সোশাল মিডিয়াজুড়ে এখন সেই কয়েন নিয়ে মিমের ছড়াছড়ি ।
মহুয়া অবশ্য এই বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন । টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘মনে হচ্ছে আমার মিম সম্পাদনার দক্ষতা ক্রমেই উন্নত হচ্ছে । নিম্নমানের দুঃখজনক কথা বলার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী ।’ যখন তাঁর ‘দুই পয়সা’ মন্তব্যের নিন্দায় সরব অনেকে, তখনই এই পোস্ট করেন তৃণমূল সাংসদ ।
আরও পড়ুন , "দু'কোটির থেকে 'দু পয়সা' অনেক দামি", মহুয়াকে কটাক্ষ কমলেশ্বর-রুদ্রনীলের
এই ঘটনার প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক সংবাদ মাধ্যম মহুয়াকে ‘বয়কট’ করার সিদ্ধান্ত নেয় । তৃণমূল সাংসদকে কোনও রকম কভারেজ না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । কিন্তু মহুয়া যে তাতে দমবার পাত্রী নন, তা তিনি বুঝিয়ে দেয় তাঁর দ্বিতীয় টুইট । সেখানে তিনি লেখেন, ‘দুঃখিত জি । কিন্তু কাউকে বয়কট করার অর্থ কি এটা নয় যে তাঁকে নিয়ে লেখালিখি বন্ধ করে দেওয়া এবং তাঁকে একেবারেই কভারেজ না দেওয়া?’ ওই টুইটেই বিজেপিকে উদ্দেশ করে তিনি অভিযোগ করেন, ‘এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে এটা বিজেপি-র ট্রোল করার কৌশল এবং আপনারা তাতে সায় দিচ্ছেন ।’
তৃণমূল সাংসদের এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছে কলকাতা প্রেস ক্লাব । একটি বিবৃতি জারি করে ক্লাবের তরফে বলা হয়েছে, ‘মহুয়া মৈত্রের এই মন্তব্যের আমরা তীব্র নিন্দা করি ।’ কৃষ্ণনগরের সাংসদের মন্তব্যকে অযৌক্তিক এবং অপমানজনক হিসাবে ব্যাখ্যা করে ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, ‘‘গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার গুরুত্ব এবং সম্মান সম্পর্কে সকলেই অবগত । সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ পরিস্থিতিতে কাজ করা, পেশাগত বিভিন্ন সমস্যা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদির কারণে সংবাদিকরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সম্মান পেয়ে থাকেন । সাংবাদিকদের অপমান করার অধিকার কারও নেই । আমরা সাংসদের এই মন্তব্যের বিরোধিতা করছি এবং আশা করছি তিনি তাঁর এই মন্তব্য ফিরিয়ে নেবেন এবং ক্ষমা চাইবেন ।’’
সোশাল মিডিয়াজুড়ে মহুয়ার মন্তব্যের কাটাছেঁড়া এবং আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের ঘটনা যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে এই কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকেই তাঁর পূর্বসূরিকে ।
2014 সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে এই কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের কিছু মন্তব্যও মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল । নদিয়ার চৌমাহায় 14 জুন সেই সময়ের সাংসদ তাপস পাল বিরোধীদের ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে ধর্ষণ এবং খুনের হুমকি দিয়েছিলেন ।
চৌমাহায় সে দিন তাপস বলেছিলেন, “সিপিএম-এর কেউ যদি আমার মা, বোন, কাকা বা কাকিমার গায়ে হাত দেওয়ারও চেষ্টা করে, তা হলে আমি, এই তাপস পাল তাদের ছেড়ে কথা বলব না । তাপস পাল নিজের রিভলভার বের করে ওদের গুলি করবে । মনে রাখবেন আমি কলকাতার নই, চন্দননগরের মাল । তৃণমূলের মেয়ে, বাবা বা সন্তানকে বিরোধীদের কেউ যদি ছোঁয়ারও চেষ্টা করে তা হলে আমি তাদের বংশ ছারখার করে দেব । ওদের ঘরে আমি আমার ছেলেদের ঢুকিয়ে দেব । ওরা ধর্ষণ করে দেবে ।” তাপস পালের এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া ওঠে । নিন্দায় সরব হয় সব মহল । পরে সাংসদের স্ত্রী নন্দিনী ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন ।
আরও পড়ুন , "দু'পয়সার প্রেস", সমালোচনার মুখে "সঠিক মন্তব্য"-র জন্য ক্ষমাপ্রার্থী মহুয়া মৈত্র
মহুয়া মৈত্রের এই মন্তব্যের রেশ কাটতে যে এখনও দেরি আছে তা বলাই বাহুল্য । দলে অনুব্রত মণ্ডলের মতো নেতা থাকায় বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠতেই পারে ।
ঘটনাচক্রে তাপস পাল এবং মহুয়া মৈত্র, তৃণমূলের দুই সাংসদই এই ধরনের মন্তব্য করেছেন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ঠিক আগে । তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ইতিমধ্যেই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়েছেন ।
সাংবাদিকদের নিয়ে করা মহুয়ার এই মন্তব্য থেকে যখন তৃণমূলের বিধায়ক এবং সাংসদরা ক্রমেই দূরত্ব বাড়াচ্ছেন, তখনই রানিগঞ্জে এক সভায় মমতা বলেন তিনি এবং তাঁর দল সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা করেন । মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর দলের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো বলেও দাবি করেন তিনি । ওই সভায় তিনি বলেন, ‘‘প্রেস-মিডিয়ার একটা সম্মান আছে । যদি কেউ মনে করেন টাকার প্যাকেট দিয়ে সবাইকে কিনবেন, তা হলে বলব বাংলায় সবাইকে কেনা যায় না ।’’ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তৃণমূল ভবনে বলেন, ‘‘মহুয়ার বক্তব্য দলের নয় । মমতার সঙ্গে সাংবাদিকদের সুসম্পর্ক দীর্ঘ দিনের ।’’ মহুয়ার নিন্দায় সরব মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সাংসদ নুসরত, মিমিরাও ।
2011 সালে রাজ্যে সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মমতা তথা তৃণমূল ক্ষমতা দখল করে । তখন তাঁর এবং তাঁর দলের সমর্থকদের স্লোগান ছিল, ‘বদলা নয় বদল চাই’। আসন্ন নির্বাচনে তাঁর দলের সাংসদের করা মন্তব্য কি বিরূপ প্রভাব ফেলবে? মহুয়ার মন্তব্য নিয়ে তীব্র আক্রমণ করা নেটিজেনদের উপর এর কতটা প্রভাব পড়বে?
আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ফলাফল প্রকাশ্যে আসবে । আর তত দিন পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসকে তাড়িয়ে বেড়াবে এই দুই পয়সার কয়েনের ভূত ।